করোনার প্রভাব কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশের বেসরকারি খাত। বাড়ছে আমদানি-রপ্তানি। চাঙা হচ্ছে অর্থনীতি। করোনাকালীন সময়ের আগের অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করেছে সবকিছু। ফলে গতি ফিরছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি নভেম্বরের চেয়ে দশমিক ৫৭ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশে উঠেছে। যা নভেম্বরে ছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। এছাড়া অক্টোবরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে হয়েছিল ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের স্থিতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ লাখ ৬৩ হাজার ২৪৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণ ছিল ১১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৫৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০২০ সালের ডিসেম্বরের চেয়ে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এক লাখ ২১ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা বা ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেশি ঋণ পেয়েছেন। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, বেশি পরিমাণে আমদানি বৃদ্ধি, বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বাড়ার ফলে বেসরকারি খাতের ঋণ বাড়ছে।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়া অর্থনীতির জন্য খুবই ভালো দিক। এর মাধ্যমে দেশে বিনিয়োগ বাড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তার মানে নতুন বছর বিনিয়োগের একটি ইতিবাচক আবহ নিয়েই শুরু হচ্ছে।’
কোভিডের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন এ খাতে ফের কিছুটা প্রভাব ফেলবে আশঙ্কা করে তিনি বলেন, জানুয়ারির শুরু থেকে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এর ফলে আগামী মাসে বেসরকারি ঋণ কিছুটা কমবে। তবে ফেব্রুয়ারিতে আবার বাড়বে বলে প্রত্যাশা তার। তিনি বলেন, বেসরকারি খাতের ঋণ ২০ শতাংশে যেতে পারে। এতে অর্থনীতিতে পুরোপুরি গতি ফিরবে। এর বেশি হলে কিছুটা সমস্যাও রয়েছে।
চলতি অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক গত জুলাই মাসে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল, তাতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয় ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ডিসেম্বর শেষে উদ্যোক্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যের চেয়ে এখনও প্রায় ৪ শতাংশ ঋণ কম পেয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কোভিডের কারণে গত মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি খুবই কম ছিল। সে সময়ে ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে ঋণের প্রবৃদ্ধি নেমেছিল। এরপর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ছে।
এর আগে ২০২১ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৫১ ও ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এপ্রিলে নেমে আসে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে। মে মাসে তা আরও কমে নেমে যায় ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে। তবে করোনার প্রকোপ কমতে থাকায় জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি খানিকটা বেড়ে ৮ দশমিক ৩৫ শতাংশে উঠে কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়। তারপর থেকে ঋণপ্রবাহ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। জুলাই ও আগস্টে এই সূচক ছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৩৮ ও ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জা মো. আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার প্রভাব কমে আসায় ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হয়েছে, শিল্প-কারখানা পুরোপুরি চালু হয়েছে। রপ্তানি আদেশ আসছে। আমদানিও বেড়েছে। অর্থনীতি সচল হওয়ায় বেসরকারি ঋণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই ভালো দিক। কারণ বিনিয়োগ বাড়া মানে ব্যবসার পরিধি বাড়বে, নতুন কর্মসংস্থান হবে।
তবে এসব বিনিয়োগ বা ঋণ সঠিক জায়গায় হচ্ছে কি না সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে এ অর্থ উপদেষ্টা বলেন, পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, বিনিয়োগ বাড়লে অর্থ পাচারের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। তাই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তদারকির মধ্যে রাখতে হবে। ঋণ প্রবাহ যেন ঋণ উৎপাদনশীল খাতে বেশি যায় পাশাপাশি এক খাতের ঋণ নিয়ে অন্য জায়গায় না চলে যায়, এ বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন এই জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৩ হাজার ১৬৬ কোটি ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছে। এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের এ পাঁচ মাসে আমদানি হয়েছিল ২ হাজার ২৪ কোটি ডলারের পণ্য।
এছাড়া জুলাই-নভেম্বর সময়ে ইপিজেডসহ অন্যরা বিভিন্ন ধরনের পণ্য রফতানি করে এক হাজার ৮৬৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি।