ঢাকা: বিদেশগামী যাত্রীদের করোনা নেগেটিভ সনদ বাধ্যতামূলক হওয়ায় এদের ঘিরে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে একটি চক্র। স্যাম্পল দেওয়া বিদেশগামীদের টেস্টের আগেই পজিটিভ এসেছে বলে ফোন দেওয়া হতো।
নেগেটিভ করে দেওয়ার আশ্বাসেই জনপ্রতি হাতিয়ে নিতো ৫-২০ হাজার টাকা!
এদিকে, টাকা দেওয়ার পরও অনেকের পজিটিভ রিপোর্ট আসায় তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানালে বুঝতে পারেন প্রতারিত হওয়ার কথা। এ কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের কোন সম্পৃক্ততা নেই, টেস্টের বিষয়ে চক্রটি অবগত নয়। শুধুমাত্র যাত্রীদের ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে ফোন দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিতো।
এমন কিছু অভিযোগের ভিত্তিতে কুমিল্লার কোতোয়ালি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকার সায়েদাবাদ, রমনা ও মতিঝিল এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৪ জনকে আটক করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
আটকরা হলেন- জসিম উদ্দিন (২২), সুলতান মিয়া (১৯), বেলাল হোসেন (৩১), আবুল হোসেন (২৪), আবদুল নুর (২১), আলফাজ মিয়া (১৯), শামিম (৩২), আহাম্মদ হোসেন (১৯), ইমরান উদ্দিন মিলন (১৯), সবুজ মিয়া (২৭), আব্দুর রশিদ (২৮), আব্দুল করিম চৌধুরী (৩২), আঙ্গুর মিয়া (২৫) ও আলমগীর হোসেন (২০)।
এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রায় সাত লাখ টাকা, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ১২০টি সিমকার্ড, সিম অ্যাক্টিভেট করার ১টি ফিঙ্গার প্রিন্ট মেশিন, ১টি ট্যাব, ৩২টি মোবাইল, ১টি পাসপোর্ট, নোটবুক এবং চক্রের সদস্যদের বেতনের হিসাব বিবরণী জব্দ করা হয়।
র্যাব জানায়, চক্রের মূলহোতা বেলাল নিজেই বিদেশ যাওয়ার সময় নেগেটিভ সনদ প্রাপ্তির আশ্বাসে প্রতারণার শিকার হন। এরপর তিনি নিজেই এমন প্রতারণার উদ্দেশ্যে একটি চক্র গড়ে তোলেন। এমনকি প্রতারণা চালিয়ে যেতে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসেন।
বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
চক্রের মূলহোতা বেলালকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, গত মার্চে ওমান যাওয়ার জন্য কুমিল্লার একটি হাসপাতালে করোনা টেস্টের নমুনা দেন। এরপর অজ্ঞাতপরিচয় একজন হাসপাতালের ডাক্তার পরিচয় দিয়ে তার করোনা টেস্টের ফলাফল পজিটিভ এসেছে বলে জানায়। ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে বেলালের করোনা টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ করার প্রতিশ্রুতি দিলে, তিনি চড়া মূল্যের টিকিট বাতিল হওয়ার চিন্তা করে ১০ হাজার টাকা পাঠায়। পরবর্তীতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে করোনা পজিটিভ ফলাফল পাঠায়। পরবর্তীতে হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ওই ব্যক্তি হাসপাতালের কেউ নয় বলে জানায়। প্রতারিত হয়েছেন বুঝতে পেরে এপ্রিল মাসে আবার টেস্ট করে ওমান যান।
র্যাবের ওই কর্মকর্তা বলেন, মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বেলাল প্রতারণার এই প্রক্রিয়াটি নিয়ে ব্যাপক বিশ্লেষণ করেন। এর মধ্যে তিনি নিজেই বিদেশগামী যাত্রীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার রুপ রেখা তৈরি করেন। তবে, তার বিদেশে চলে যাওয়ায় তার এই পরিকল্পনা বন্ধু সবুজকে অবগত করেন। বেলালকে প্রতারণার অর্থের একটি অংশ দেবে এমন শর্তে সবুজকে দায়িত্ব দিয়ে তিনি বিদেশ চলে যায়।
সবুজ যে প্রতারণার অর্থ পাঠাতো তা নিয়ে সংশয় থাকায় গত আগস্ট মাসে দেশে ফিরে আসেন বেলাল। এবার তার আরেক বন্ধু জসিমকে এই প্রতারণার কাজে সম্পৃক্ত করেন। ভিসা সচল রাখতে ডিসেম্বরে আবার বিদেশ গিয়ে গত জানুয়ারিতে দেশে ফিরেন বেলাল। আর এদিকে বিদেশগামী যাত্রীদের করোনা টেস্ট নিয়ে প্রতারণা চালিয়ে যেতে থাকেন।
যেভাবে প্রতারণা
চক্রের অন্য সদস্যরা সরকার নির্ধারিত বিদেশগামীদের করোনা টেস্ট হাসপাতালগুলোতে সকাল ৭টা থেকে ১২টা পর্যন্ত যাত্রীবেশে অবস্থান করে কৌশলে যাত্রীদের ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে। এরপর নম্বরগুলো বেলাল ও সবুজকে পাঠানো হতো। যাত্রীরা প্রকৃত করোনা টেস্টের ফলাফল হাতে পাওয়ার আগেই বেলাল ও সবুজ সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের করোনা বিভাগের কেউ পরিচয় দিয়ে ফোন দিয়ে ফলাফল পজিটিভ আসছে বলে জানায়। পজিটিভ রেজাল্ট নেগেটিভ করতে জনপ্রতি ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিতেন।
আলফাজ, জসিম, শামিম ও সুলতান একই সময়ে বেলাল ও সবুজকে বিভিন্ন জায়গার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নাম্বার দিতো। ভুক্তভোগীরা বেলাল ও সবুজের কথা অনুযায়ী টাকা পাঠালে আলফাজ, জসিম, শামিম ও সুলতান তা সংগ্রহ করতেন। ভুক্তভোগীর অবস্থান চিহ্নিত করে ভিন্ন জেলা থেকে টাকা সরবরাহ করা হতো।
সিম সরবরাহে কারসাজি
চক্রটি একটি সিম একদিন ব্যবহার করে তা কিছুদিন বন্ধ রেখে পুনরায় ব্যবহার করতেন। কোন নাম্বার নিয়ে সন্দেহ হলে তা ফেলে দিতেন। প্রতারণা করতে মিলন খোলা বাজারের ১২০ টাকার সিম ভুয়া রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে এক হাজার টাকার বিনিময়ে বেলাল ও সবুজকে দিতেন। এসব সিমের যোগানদাতা ছিলেন আটক ইমরান উদ্দিন মিলন। তিনি খোলা বাজারে সিম বিক্রি করতেন। তার কাছে কেউ সিম কিনতে এলে কৌশলে তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও এনআইডি কার্ড দিয়ে একাধিক সিম রেজিস্ট্রেশন করে এই চক্রের কাছে চড়া দামে বিক্রি করতেন।
নেগেটিভ সনদের আশ্বাসে প্রতারণায় কোটিপতি
সবুজ মিয়া জানায়, গত ১০ মাসে সহস্রাধিক বিদেশগামী যাত্রীর কাছ থেকে জনপ্রতি ১০-১৫ হাজার করে প্রায় কোটি টাকা আয় করেছে। প্রতারণার টাকা দিয়ে তিনি তার গ্রামের বাড়িতে একটি পাকা বাড়িও তৈরি করেছেন। আর বেলাল হোসেন বিদেশ থেকে এসে এই প্রতারণার মাধ্যমে ৬ শতাধিক বিদেশগামীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ৫০ লাখ টাকা। বাকি সদস্যরা এই প্রতারণার মাধ্যমে মাসে ২৫/৩০ হাজার টাকা আয় করতেন।