সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ নতুন কিছু নয়। প্রতিনিয়ত সেবাগ্রহীতাদের দুর্নীতি নামক ভাইরাসের মুখোমুখি হতে হয়। যে কারণে প্রতিকার পেতে দুর্নীতির ফিরিস্তি নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দ্বারস্থ হতে হয় ভুক্তভোগীদের।
জনগণেরও প্রত্যাশা থাকে আইন অনুযায়ী দুদক অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্ত করে অপরাধীর সাজা নিশ্চিত করবে। আর যদি দুদকের তফসিলের বাইরের কোনো দুর্নীতির অভিযোগ থাকে তা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। দুদক সূত্রে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে গঠিত সংস্থাটি অভিযোগ অনুসন্ধানের চেয়ে সরকারি দপ্তরে চিঠি দেওয়ার প্রবণতা বাড়িয়েছে। বিপরীতে কমেছে অভিযোগ অনুসন্ধানের সংখ্যাও।
দুদকেরই পরিসংখ্যান বলছে, গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে ১০ হাজার ৭৬৬টি চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। বিপরীতে এসব অভিযোগের বিষয়ে আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না— জানা নেই দুদক কর্তৃপক্ষের।
গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে ১০ হাজার ৭৬৬টি চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। বিপরীতে এসব অভিযোগের বিষয়ে আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না— জানা নেই দুদক কর্তৃপক্ষের
এমনও নজির রয়েছে, যে বিভাগীয় প্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার কাছেই আইনি ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ফলে অভিযোগের অধিকাংশই ফাইলবন্দি হয়ে পড়ছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি পাঠানোর পর পরবর্তীতে ফলো-আপ হয় না, এমনকি সরকারি ওই দপ্তর থেকেও দুদককে কিছু জানানো হয় না।
দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন। যে কারণে কৌশল পরিবর্তন করছে সংস্থাটি। দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. মোজাম্মেল হক খান এমনটি জানালেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘নীতিগতভাবে আমি এ ধরনের চিঠি দেওয়ার পক্ষে নই। আমরা যাদেরকে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলি, তার ১০ শতাংশ ব্যবস্থা নিয়েছে কি না— আমাদের কাছে এর কোনো খবর নাই। সবাই বলেন, তদন্ত করে দেখেছেন। কিন্তু এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। এটা (ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি) বেশি পাঠানো যে লাভজনক নয়, আমারও তা মনে হয়।’
এ কারণে অভিযোগ নিষ্পত্তিতে দুদক কৌশল পরিবর্তন করেছে— এমন মন্তব্য করে মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘আমরা আমাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছি। অভিযোগের বিষয়ে তারা (সংশ্লিষ্ট দপ্তর) কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সে বিষয়ে এখন দুদককে অবহিত করার কথা বলছি। ফলে তাদের মধ্যেও কাজ করবে যে সত্যি সত্যি যদি ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, পরবর্তীতে দুদক ধরতে পারে। আশা করি তারা এখন থেকে আন্তরিক হবে।’
এমনও নজির রয়েছে, যে বিভাগীয় প্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার কাছেই আইনি ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ফলে অভিযোগের অধিকাংশই ফাইলবন্দি হয়ে পড়ছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি পাঠানোর পর পরবর্তীতে ফলো-আপ হয় না, এমনকি সরকারি ওই দপ্তর থেকেও দুদককে কিছু জানানো হয় না
‘অনেক সময় এমনও অভিযোগ আসে, সেখানে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকে না। অনেক সময় ওয়াসা, বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাসের লাইনের ক্ষেত্রে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ থাকে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত থাকে না। ওই সব অভিযোগ যদি সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাহলে অন্তত তারা সতর্ক হবে যে দুদকের কাছে অভিযোগ যাচ্ছে। এমন কাজ আর করা যাবে না। অনেক সময় যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকেও ডেকে সতর্ক করা হয়।’
দুদকের চিঠি কি আদৌ কার্যকর, কী বলছে পরিসংখ্যান
দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে দুদকের পাঠানো চিঠি সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না— এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা মেলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) পাঠানো চিঠির পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিলে। গত তিন বছরে ১৮৪টি অভিযোগ নিষ্পত্তিতে মাউশিকে চিঠি পাঠায় দুদক। কিন্তু সে বিষয়ে বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় গত ২৯ ডিসেম্বর মাউশি মহাপরিচালক প্রফেসর ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুককে তলব করে দুদক। তলবের পর পেন্ডিং অভিযোগের বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় দেয় সংস্থাটি। একই সঙ্গে দুদকের পাঠানো অভিযোগগুলোর বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানাতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে একজন ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা রাখারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
চিঠি দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা ‘দায়সারা’
শুধুমাত্র চিঠি দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি অনেকটা ‘দায়সারা’ হিসেবে দেখছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘দুদক অবশ্যই তার অবস্থান থেকে বিভাগীয় ব্যবস্থা হিসেবে চিঠি দিতেই পারে। তবে শুধুমাত্র এর ওপর নির্ভর করে থাকাটা সঠিক বলে মনে করি না। যদি এমন অভিযোগ থাকে, যেখানে দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে সেখানে শুধুমাত্র বিভাগীয় ব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়।’
‘দুর্নীতি হয়ে থাকলে শাস্তিমূলক বদলি ও সাময়িক বরখাস্ত; ইত্যাদির মতো ছোটখাটো সাজা যথেষ্ট নয়। এর দ্বারা দুদকের মৌলিক দায়িত্ব দুর্নীতি দমনের কাজ সম্পূর্ণ হয় না। পাশাপাশি দুদকের উচিত হবে, যে সব অভিযোগে সত্যিকারের দুর্নীতি হয়েছে, সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। কেননা, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, সেটা সরকারি কর্মকর্তা হোক কিংবা অন্য যে-ই হোক; সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। এটাই দুদকের অর্পিত দায়িত্ব। এর ঘাটতি হলে প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক। দুদক এক্ষেত্রে দায় এড়াতে পারে না।’
আমি মনে করি, দুদকের উচিত হবে দুটোই যুক্তিযুক্তভাবে চালানো। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, একা দুদকের পক্ষে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। যদি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন না করে তাহলে মুশকিল— যোগ করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
দুদকের পরিসংখ্যান যা বলছে
দুদক থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালে দুদক মোট ১৭ হাজার ৯৮৩টি অভিযোগ পায়। এর মধ্যে ৯৩৭টি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৩৭৭টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে পাঠিয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে চিঠি দেওয়া হয়।
একইভাবে ২০১৮ সালে ১৬ হাজার ৬০৬টি অভিযোগের মধ্যে এক হাজার ২৬৫টি অনুসন্ধান এবং এক হাজার ৪০৪টি অভিযোগ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়। ২০১৯ সালে ২১ হাজার ৩৭১টি অভিযোগ থেকে এক হাজার ৭১০টি অনুসন্ধান এবং তিন হাজার ৬২৭ অভিযোগ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়।
২০২০ সালে ১৮ হাজার ৪৮৯টি অভিযোগ থেকে ৮২২টি অনুসন্ধান এবং দুই হাজার ৪৬৯টি অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেয় দুদক। সর্বশেষ ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪ হাজার ৮৪৯টি অভিযোগ থেকে মাত্র ৫৩৩টির অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। বাকি দুই হাজার ৮৮৯টি অভিযোগ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেয় দুদক
২০২০ সালে ১৮ হাজার ৪৮৯টি অভিযোগ থেকে ৮২২টি অনুসন্ধান এবং দুই হাজার ৪৬৯টি অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেয় দুদক। সর্বশেষ ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪ হাজার ৮৪৯টি অভিযোগ থেকে মাত্র ৫৩৩টির অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। বাকি দুই হাজার ৮৮৯টি অভিযোগ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেয় দুদক।
কমেছে অনুসন্ধানের হারও
দুদক সূত্রে জানা যায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের বছর অর্থাৎ ২০২০ ও ২০২১ সালে দুদকের অনুসন্ধান কার্যক্রমও কমে অর্ধেকে নামে। সংক্রমণ শুরুর আগের দুই বছর অর্থাৎ ২০১৮ ও ২০১৯ সালে মোট দুই হাজার ৯৭৫টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য সিদ্ধান্ত নিলেও পরের দুই বছর এ সংখ্যা কমে দাঁড়ায় এক হাজার ৩৫৫টিতে।
যদিও আগের দুই বছরের তুলনায় পরের দুই বছর দুদকে দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগ কিছুটা কম জমা পড়ে। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে মোট ৩৭ হাজার ৯৭৭টি অভিযোগ জমা পড়ে, এর মধ্যে প্রায় আট শতাংশ অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করে দুদক।
পরের দুই বছর অর্থাৎ ২০২০ ও ২০২১ সালে অভিযোগ জমা পড়ে ৩৩ হাজার ৩৩৮টি। এর মধ্যে ৪ শতাংশ অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন।
অনুসন্ধান কমে যাওয়া প্রসঙ্গে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অতীতে যে ধরনের অভিযোগ অনুসন্ধান করে কোনো ফল পাওয়া যায়নি, ওই ধরনের অভিযোগ কমিশন এখন আর আমলে নিচ্ছে না। ফলে অনুসন্ধানের সংখ্যা কমেছে। এছাড়া গত দুই বছর করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে বিভিন্ন সময় নানা বিধিনিষেধ ছিল। এ কারণেও অভিযোগ ও অনুসন্ধানের সংখ্যা কম।’
দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১৫ সালে ১০ হাজার ৪১৫টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে এক হাজার ২৪০টির অনুসন্ধান করা হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে ১২ হাজার ৯৯০টি অভিযোগ পেয়ে এক হাজার সাতটির অনুসন্ধান করে দুদক।