নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার কাশীপুরের হোসাইনি নগর এলাকায় জোড়া খুনের মামলার এজাহারনামীয় আসামি বাপ্পী শিকদার ও আমান ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গ্রেফতার আমান ভূঁইয়া গত সোমবার (১৭ জানুয়ারি) নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নুরুন্নাহারের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
গতকাল মঙ্গলবার (১৯ জানুয়ারি) দুপুর ১২টার দিকে সংবাদ সম্মেলনে আলোচিত এ মামলা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানিয়েছেন পিবিআইয়ের নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মো. মনিরুল ইসলাম।
তিনি জানান, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মামলার আসামি আমান ভূঁইয়া জানিয়েছেন- কিলিং মিশনে মামলার এজাহারনামীয় ২২ জন আসামিসহ আরও ১২ জন ছিল। জবানবন্দিতে কিলিং মিশনে থাকা বাকি আসামিদের নামও প্রকাশ করেছেন গ্রেফতার আমান।
মনিরুল ইসলাম জানান, মামলার ২ নম্বর এজহারনামীয় আসামি বাপ্পী সিকদারকে গত ১২ জানুয়ারি বন্দর থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যমতে গত ১৬ জানুয়ারি অত্র মামলার ৫ নম্বর এজাহারনামীয় আসামি আমান ভূঁইয়াকে বন্দর থানার ঘারমোড়া এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। আসামি আমান ভূঁইয়া গত ১৭ জানুয়ারি সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নুরুন্নাহারের আদালতে
হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে এজাহারনামীয় সকল আসামিসহ নতুন করে আরও ১২ জনের নাম প্রকাশ করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
তিনি আরও জানান, বাপ্পি সিকদার ও আমান ভূঁইয়াকে গ্রেফতারে কমপক্ষে ১৫ বার সাড়াশি অভিযান পরিচালনা করেও ধরা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে জানা গেছে, তারা গ্রেফতার এড়াতে তাদের এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে পঞ্চায়েত কমিটি কর্তৃক লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরার পাসওয়ার্ড চুরি করে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। তাছাড়া আসামিরা এতটাই কৌশলী যে, তারা তাদের বাসার ছাদে মই রেখে গ্রেফতার অভিযানের সংবাদ পাওয়া মাত্র পালিয়ে যেত। এই মামলায় এখন পর্যন্ত ২ জন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
এর আগে ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর কিলিং মিশনে থাকা মাহবুব স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আদালতকে জানিয়েছেন, নারায়ণগঞ্জ বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক কমিশনার এম এ মজিদের নির্দেশেই সদর উপজেলার ফতুল্লার কাশীপুরে ডাবল মার্ডারের ঘটনা ঘটেছে।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১২ অক্টোবর রাতে মাদক ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধে কাশীপুরের হোসাইনি নগর এলাকায় একটি রিকশার গ্যারেজে সশস্ত্র হামলাকারীরা তুহিন হাওলাদার মিল্টন ও পারভেজ আহমেদ নামে দুইজনকে কুপিয়ে হত্যা করে। হত্যার পরে আলামত বিনষ্টে গ্যারেজে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। এরপর এলাকাবাসী এসে আগুন নিভিয়ে পুলিশকে খবর দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে দগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য প্রেরণ করে।
এ ঘটনায় নিহতদের পরিবার এতটাই ভীত ছিল যে তারা মামলা করতেও সাহস পায়নি। ফলে ১৪ অক্টোবর দুপুরে ফতুল্লা মডেল থানার এসআই মোজাহারুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির উপদেষ্টা ও বিলুপ্ত শহর কমিটির সহ-সভাপতি এম এ মজিদ ও তার ভাই বিলুপ্ত শহর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান আহমেদের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তাদের ইন্ধন থাকতে পারে।
ওই বছরেরই ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের হানিফ খান মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে নিহতদের পরিবার নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার কাশীপুরে জোড়া খুনের ঘটনায় মহনগর বিএনপির উপদেষ্টা এমএ মজিদ ও তার ভাই বিলুপ্ত শহর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান আহমেদকে ‘ঠান্ডা মাথার খুনি’ অখ্যায়িত করে।
লিখিত বক্তব্যে নিহত মিল্টনের খালাতো ভাই সাইফুল তারেক বলেন, এম এ মজিদ ও মো. হাসান আহম্মেদের নির্দেশে মিল্টন ও পারভেজকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার পর আলামত নষ্ট করার জন্য ঘটনাস্থলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ১২ অক্টোবর রাতে মজিদ ও হাসান আহাম্মেদের মোবাইল ফোনের কথোপকথন ট্র্যাকিং করলেই সব দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।
মামলার আসামিরা হলেন- নগরীর ১ নং বাবুরাইলের শুক্কুর মিয়ার বাড়ির ভাড়াটিয়া জয়নাল আবেদীনের ছেলে জাহাঙ্গীর বেপারী (৪০), বাবুরাইল তারা মসজিদ এলাকার কাজল মিয়ার ছেলে বাপ্পী সিকদার (২৮), রবিন (৩০), রকি (২৮), ভূইয়াপাড়া এলাকার মজনু মিয়ার ছেলে আমান ভূঁইয়া (৩২), বাবুরাইল শেষমাথা এলাকার খোকা মিয়ার ছেলে শহিদ (৩০), বাবুরাইল তারা মসজিদ এলাকার আসলাম (৫০), বাবুরাইল ঋষিপাড়া এলাকার মৃত জাকিরের ছেলে মাহাবুব (৩০), বিএনপি নেতা হাসান আহমেদের ভাতিজা শিপলু (৩০) ও রাসেল (৩৩), বাবুরাইল এলাকার মুক্তা (২৮), পাইকপাড়া জিমখানা ডিমের দোকান এলাকার শরীফ (৩৩), বাবুরাইলের রানা (২৮), বাবুরাইলের কিরণ (৩০), মানিক (৩০), বাবুরাইলের আবদুল মান্নানের ছেলে ফয়সাল (২৬), বন্দর এলাকার রাব্বি (৩০), বাবুরাইলের নিলু সরদারের ছেলে সোহাগ (৩২), বাবুরাইল শেষমাথা এলাকার রাকিব (২৭), বাবুরাইল ঋষিপাড়া এলাকার সিরাজ মিয়ার ছেলে রাজন (৩০), বাবুরাইল এলাকার রিকশাচালক আবুল (৩৫), একই এলাকার ফরহাদ (৫২) সহ অজ্ঞাত আরো ১শ থেকে ১শ ২৫ জন। মামলার আসামিরা সবাই বিএনপি নেতা মজিদ ও হাসান বাহিনীর লোক হিসেবে পরিচিত।