সামাজিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে দেশজুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন বাতিল হওয়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে এখন তারা সংগঠন গোছানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে বেশি। দেশব্যাপী দাওয়াতি কাজের মধ্য দিয়ে গড়ে তুলছে দক্ষ কর্মীবাহিনী। ৩০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে সক্রিয় হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারী ধর্মভিত্তিক দল জামায়াত। সংগঠনের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এখন সামাজিক কর্মকাণ্ডের দিকে মনোনিবেশ করছেন। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এ কৌশল বেছে নিয়েছেন। তাদের দাবি, গৃহীত কৌশলে তারা সফল। সাধারণ মানুষের কাছে সহজে পৌঁছতে পারছেন।
সূত্র জানায়, জামায়াতের চারটি মৌলিক কাজের সঙ্গে সম্প্রতি ‘সামাজিক কাজ’ বলে একটি অংশ যুক্ত হয়েছে। আগে ছিল দাওয়াতি, কর্মী প্রশিক্ষণ, অর্থের জোগান ও কর্মীদের মানোন্নয়ন। এখন থেকে তারা সামাজিক কাজে সবচেয়ে বেশি সময় দিচ্ছেন। তৃণমূলে এ কর্মকাণ্ডের পরিধি বাড়াচ্ছে সংগঠনটি। সামাজিক কাজের মধ্য দিয়ে নতুন কর্মী তৈরি করছে। রমজানে বিভিন্ন জায়গায় ইফতার মাহফিল, ঈদ উপহার বিতরণ, জাকাত দান, পোড়া বস্তিতে গিয়ে সহায়তা, বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার ও অসহায় মানুষের বাসায় গিয়ে আর্থিক সহযোগিতা, ঈদের পর এলাকায় গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময়, খেলাধুলার আয়োজনসহ নানা সামাজিক কাজে ব্যস্ত রয়েছে জামায়াত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নেতা সময়ের আলোকে বলেন, জামায়াতের সাংগঠনিক কাজ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলছে। আপাতত নির্বাচন নিয়ে কেন্দ্র থেকে নতুন কোনো বার্তা দেওয়া হয়নি; তবে তাদের প্রস্তুতি রয়েছে। সামনের আন্দোলনের জন্য দক্ষ কর্মীবাহিনী তৈরি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, জামায়াতের কোনো কর্মী যাতে দলছুট না হতে পারে সেদিকেও নজর রাখা হচ্ছে। তাদের বিপদে পাশে দাঁড়ানো, সংগঠনের পক্ষ থেকে জেলে থাকা নেতাকর্মীদের মামলা মোকাবিলা করা, কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে প্রয়োজনবোধে ভুক্তভোগীর পরিবারকে সহায়তা করা হচ্ছে।
আরেকটি সূত্রের দাবি, ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী ভিন্ন চিন্তা নিয়ে এগোচ্ছে। তারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পর্দার আড়ালে নানা কলাকৌশল গ্রহণ করছেন। প্রথমে তারা বিএনপিকে বাইরে রেখে এলডিপির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গড়ার চেষ্টা করেছেন। এরপর মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিমকে নিয়েও চেষ্টা করেছেন তারা। এখনও নতুন রাজনৈতিক মঞ্চের ভেতর দুটি দলের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। অন্যদিকে জামায়াত বিএনপির মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছে।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, জামায়াত একটি নির্বাচনমুখী দল। আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি। কর্মিসম্মেলন থেকে শুরু করে রুকন বৈঠক, দাওয়াতি কাজ, মানবতার কল্যাণ- সবই চলছে নিয়মমাফিক। তিনি বলেন, আমরা বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটে আছি। আমরা জোটের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে থাকতে চাই। এখন বিএনপি কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু মনে রাখতে হবে, অর্থবহ আন্দোলন জামায়াত ছাড়া সম্ভব নয়। একটি কমন ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করবে জামায়াত।
সংগঠনের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, চাপ ও দমন-পীড়নের মধ্যেই কাজ করে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। জনস্বার্থ ইস্যুতে মিছিল-মিটিং করছি। আমরা থেমে নেই। মাঠে আছি। সময় হলে ব্যাপকভাবে মাঠে নামব।
জামায়াতের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, জোটের আনুষ্ঠানিক বৈঠক না হলেও বিএনপির সঙ্গে তাদের আলোচনা চলছে। রমজানেও কয়েকটি ইফতারে বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দেওয়ার কথা উঠলেও জোটপ্রধান খালেদা জিয়া এখন পর্যন্ত কোনো ঘোষণা দেননি। তার নেতৃত্বেই আমরা জোটে আছি। প্রয়োজন ও পরিস্থিতি বিবেচনায় জামায়াত আন্দোলনের কর্মপন্থা নির্ধারণ করবে।
তৃণমূল জামায়াতের একজন নেতা বলেন, ৮ মাস ধরে সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেল কারাবন্দি। এ ছাড়াও শীর্ষ পাঁচজন নেতা জেলে। এতকিছুর মধ্যে সংগঠনের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত হয়নি। জামায়াত সাধারণ মানুষের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করছে। যেসব এলাকায় সংগঠনের ঘাঁটি সেগুলো পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা চলছে। জামায়াতের যেহেতু দলীয় প্রতীক নেই, তাই আগামী নির্বাচনে তারা ধানের শীষে লড়বে। সেটাও সম্ভব না হলে বিকল্প হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে ভোটের মাঠে থাকবে জামায়াতে ইসলামী। সে লক্ষ্যে নানামুখী তৎপরতা চলছে। সংগঠনের কেউ বসে নেই। সব কাজ রুটিনমাফিক হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের অক্টোবরে ধর্মভিত্তিক জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর আগে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১৭ সালের মার্চে জামায়াতের জন্য বরাদ্দ প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নির্বাচনি প্রতীকের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে গেজেট জারি করে ইসি।