তখনও মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হননি। না-শিশু, না-কিশোরী এমন বয়সে গায়ে হলুদ, বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। পায়ে আলতা রঙ আর মাথায় ঘোমটা দিয়ে বলতে হয় কবুল। ঘর-সংসার কিছু বুঝে উঠার আগেই যেতে হয় শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু সেখানে বেশি দিন ঠাঁই হয়নি তার। সন্তান জন্মের ৯ মাস না পেরোতেই মারা যায় স্বামী। এরপর শ্বশুড়বাড়ি থেকে হন বিতাড়িত।
অবুঝ শিশুকে নিয়ে দিশেহারা ১৬ বছরের কিশোরী মেয়েটি ফিরে আসেন বিধবা মায়ের কাছে। চার বছর বয়সে বাবাকে হারানো, এরপর বিয়ের স্বাদ না মিটতেই স্বামীর মৃত্যু— এমন পোড় খাওয়া অন্ধকারেও আলো খুঁজতেন তিনি। আবার ভর্তি হন ষষ্ঠ শ্রেণিতে। এরপর শুরু হয় ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধ।
নতুনভাবে পড়ালেখা শুরু করলে উল্টোপথে হাঁটতে বলেন আত্মীয়-স্বজনরা। সামাজিকতা আর ধর্মীয় গোড়ামির অজুহাতে বিধবা মেয়েটির পড়ালেখার ইচ্ছেশক্তি নষ্ট করতে উঠে পড়ে লাগে সবাই। কিন্তু তার অদম্য শক্তিকে দমিয়ে রাখা যায়নি। শেষ পর্যন্ত জীবনযুদ্ধে জয়ী হন। এখন তিনি সফল নারীদের একজন।
হৃদয়বিদারক এই গল্পের নারী অ্যাডভোকেট ছাফিয়া খানম। যার ঈর্ষণীয় সফল জীবনে আছে বাল্যবিয়ের অভিশাপ। অল্প বয়সেই বিধবা হয়ে অগোছালো জীবনের সঙ্গে লড়তে হয়েছে তাকে। দিনের বেলায়ও চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা দেখতেন। অভিভাবকহীন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন।
ছাফিয়ার দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন খালেদা খানম নামে তার এক বন্ধু। তিনিই ছাফিয়াকে ষষ্ঠ শ্রেণির বই-পুস্তক দিয়ে আবার স্কুলে ভর্তি করে দেন। মনোবল বাড়াতে লেখাপড়ার খরচও জোগান দেন।
নতুনভাবে পড়ালেখা শুরুর ইচ্ছেশক্তিতে গুড়েবালি দিতে উদ্যত পরিস্থিতিতে অবিচল ছিলেন ছাফিয়া খানম। আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি। এক হাতে বইখাতা আর অন্য হাতে কন্যাশিশুকে নিয়ে শুরু করেছিলেন নতুন জীবনের যুদ্ধ। অনেক ঝড়-ঝাপটা, দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনার সঙ্গে প্রতিনিয়ত ছিল আর্থিক অনটন। তবুও তিনি দমে যাননি।
ছাফিয়া খানম বলেন, ১৯৭৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার পর একটি চাকরি শুরু করি। তখনও সন্তানের ভরণপোষণ মিটিয়ে নিজের লেখাপড়া চালিয়েছি। চাকরিকে আঁকড়ে ধরে অবিরাম সংগ্রাম করেছি। তবু শিক্ষিত হওয়ার আশা ছেড়ে দেইনি। এইচএসসি পাস করার পর পরিবার কল্যাণ-পরিদর্শিকায় প্রশিক্ষণ নিয়ে লালপুর থানার গোপালপুরে নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছিলাম। তখন বিএ’তে ভর্তি হই।
এরই মধ্যে মেয়ে বড় হয়ে যাওয়ায় ভাইয়ের শরণাপন্ন হতে রংপুরে চলে আসেন তিনি। রংপুরে আইন নিয়ে বিএ, এমএ এবং এলএলবি সম্পন্ন করেন। আশির দশকে আইনজীবী হিসেবে এনরোলমেন্ট করার পর কয়েক বছর কোর্টে প্রাকটিস চালিয়েছেন ছাফিয়া। কিন্তু একমাত্র কন্যাসন্তানের লেখাপড়া ও সুন্দর ভবিষ্যতের ভাবনায় প্রাকটিস ছেড়ে একটি বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও) চাকরি নেন। এভাবে প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধ চলতে থাকে তার।
নানা প্রতিকূতার মধ্যেও মনের অজান্তে বঙ্গবন্ধুর আর্দশ, মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমে মুগ্ধ হন ছাফিয়া খানম। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা থেকে দুর্বলতা চলে আসে আওয়ামী লীগের ওপরও। ১৯৭৬ সালে রাজনীতিতে হাতেখড়ি নেন নাটোরের গোপালপুর আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সাংসদ মমতাজ উদ্দিনের কাছে। রংপুরে এসে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।
ছাফিয়া আরও বলেন, চাকরির পাশাপাশি পত্রিকায় লেখালেখি করতাম। এরপর গবেষণা পরিষদে যুক্ত হই। সেখানে পদ-পদবিও পেয়েছি। ওই সময়ই রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব কাঁধে আসে। নব্বই দশকে নারীদের রাজনীতিমুখী করতে মাঠে নেমে পড়তে হয়। শহরের পাড়া-মহল্লা আর গ্রামে গিয়ে নারীদের উজ্জীবিত করে সেই সময়ে মহিলা আওয়ামী লীগ গড়েছি।
১৯৯৩ সালে কাউন্সিলের মাধ্যমে মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের পর সভাপতি পদে টানা দুই যুগ পার করেন। ২০১৭ সালে রংপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মনোনয়ন চেয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী খালি হাতে ফিরিয়ে দেননি। একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশীর মধ্য থেকে ছাফিয়া খানমকে বেছে নেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
২০১৬ সালে রংপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি নির্বাচিত হন। এখন পর্যন্ত তিনিই দেশের প্রথম ও একমাত্র নারী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। জীবনযুদ্ধ থেকে ভোটযুদ্ধে জয়ী ছাফিয়া খানম ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে তিনি জেলার পীরগঞ্জ ও বদরগঞ্জে জমি উদ্ধারসহ মার্কেট নির্মাণ করেছেন। তার উদ্যোগে রংপুরের প্রাণকেন্দ্র সুপার মার্কেটের পাশে ১৮তলা বিশিষ্ট অত্যাধুনিক রংপুর সিটি সেন্টার মার্কেট নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া জেলার বিভিন্ন স্থানে মসজিদ, মন্দির, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন তিনি।
বাল্যবিয়ের মতো অভিশাপ আর অকালে স্বামীকে হারিয়েও দমে না যাওয়া ছাফিয়া খানম এখন জীবনযুদ্ধে জয়ী। অদম্য ও সফল এই নারীর জীবনের গল্পটা নদীভাঙনের মতো। তবে কখনো হোঁচট খেয়ে না থমকে বারবার ঘুরে দাঁড়াতে লড়ে গেছেন তিনি। এখন ব্যক্তি জীবনে ছাফিয়া খানমের চাওয়া-পাওয়ার আর কিছু নেই।
ছাফিয়া খানম রংপুর নগরের কামাল কাছনা এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। তার জন্ম নাটোরের লালপুর উপজেলার দুরদুরিয়া ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর গ্রামে। বাবা প্রয়াত আজহার আলী সরকার ও মা প্রয়াত গোমেদা বেগম। ছাফিয়া খানমের একমাত্র মেয়ে হোসনে আরা মাহমুদা কোলে থাকা অবস্থায় স্বামী হাবিবুর রহমান মারা যান।
অজপাড়া গাঁয়ের রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম নেওয়া ছাফিয়া ছিলেন এক ভাই ও দুই বোনের মধ্যে ছোট। চার বছর বয়সেই তার বাবা মারা যান। অভিভাবকহীন সংসারে দুই মেয়েকে নিয়ে বিপাকে পড়েন মা। এ সময় দূরসম্পর্কের চাচা ও আর এক বন্ধুর সহযোগিতায় ছাফিয়া লেখাপড়া শুরু করেন।
অ্যাডভোকেট ছাফিয়া খানম বলেন, আমার প্রবল জেদ আর মনোবলই পুঁজি ছিল। চলার পথে যেমন অবজ্ঞা-অবহেলা থাকবে, তেমনি অনেকের সহযোগিতা আর ভালোবাসাও পাওয়া যায়। তবে বড় হওয়ার জন্য সবসময় নিজের ইচ্ছেশক্তি আর পরিশ্রমই মানুষের বড় অনুপ্রেরণা