বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে বলে মিথ্যা প্রচারণা চালাত চক্রটি। এসব প্রচারণা চালিয়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১০-১২ শতাংশ হারে অগ্রিম টাকা আদায় করত।
চক্রটি বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য মোবাইলে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নামে সেভ করা ভুয়া নাম্বারে কথা বলত। একপর্যায়ে কাজ দেওয়ার কথা বলে ভুয়া দালিলিক চুক্তি করত। গত ৩ বছরে প্রতারণার মাধ্যমে অন্তত ২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।
মঙ্গলবার (১৭ মে) রাতে রাজধানীর পল্টনে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব-৩) যৌথ অভিযানে প্রতারক চক্রের প্রধান মনসুর আহমেদ (৩৩) ও তার সহযোগী মো. মহসিন চৌধুরীকে (৫৫) আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন দলিল ও ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট জব্দ করা হয়।
বুধবার (১৮ মে) সকালে রাজধানীর কারওয়ানবাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
খন্দকার আল মঈন বলেন, চক্রের সদস্যদের মোবাইল নম্বর মনসুর ও মহসিনের মোবাইলে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের নাম ও ছবি দিয়ে সেভ করত। পরে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিষয়ে চ্যাটিং করে। এসব চ্যাটিং কন্টেন্ট তারা এমনভাবে তৈরি করে যাতে যেকোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মনে করে তারা আগে অনেক কাজ অর্থের বিনিময়ে পাইয়ে দিয়েছে। তাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের খুবই সুসম্পর্ক রয়েছে বলে বোঝানো হত।
তিনি বলেন, চক্রের সদস্য সাইফুল বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতে রয়েছে। সে নিজেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জয়েন্ট সেক্রেটারি পরিচয় দেয়। ঠিকাদারদের সামনে কথিত সাইফুলের সঙ্গে লাউড স্পিকারে প্রকল্পের বিষয়ে আলোচনা করতেন মনসুর ও মহসিন। নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত ও স্বনামধন্য হিসেবে উপস্থাপন করতে তারা হাজার হাজার কেটি টাকার ভুয়া ব্যাংক গ্যারান্টি দেখাত। তারা কোনো অফিসে মিটিংয়ের সময় বেশভুষা পরিবর্তন করে দামি গাড়ি ও বডিগার্ড নিয়ে নিজেদের উপস্থাপন করত। নিজেদেরকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে উপস্থাপন করার জন্য বিভিন্ন দেশে কাজের জন্য ভ্রমণ করেছে মর্মে বিভিন্ন ছবি প্রদর্শন করত।
চক্রটি সরকারি কোনো চলমান প্রকল্পের কাজ পাওয়ার যোগ্য বিশেষ করে নদী ড্রেজিং, বাঁধ নির্মাণ করে এমন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে খুঁজে বের করত। তাদেরকে অগ্রিম ১০-১২ শতাংশ কমিশনের বিনিময়ে বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে চুক্তি করে টাকা হাতিয়ে নিত। চক্রটি বর্তমানে তিতাস নদী ড্রেজিং, আড়িয়াল খাঁ বিলের ড্রেজিং ও নদীর তীর রক্ষা বাঁধ প্রকল্প, ঢাকা মহানগর উত্তর সিটি করপোরেশনের ড্রেনের সংস্কার কাজ, রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি অফিস কনস্ট্রাকশনের কাজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশনের কাজসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেওয়ার নামে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতারণার পরিকল্পনা করছিল। তাদের কাছে তিতাস নদী ড্রেজিং ও আড়িয়াল খাঁ বিলের দুটি প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেওয়ার নামে ভুয়া চুক্তির ডকুমেন্টস পাওয়া গেছে। তারা আরো কী কী প্রকল্পের নামে কী পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তা তদন্তে জানা যাবে। তবে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, তারা গত ৩ বছরে প্রায় ২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
চক্রের আরো ৫-৭ জন সদস্যের নাম পাওয়া গেছে জানিয়ে খন্দকার আল মঈন বলেন, তাদেরকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মনসুরের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রোগ্রামের ছবি দেখা গেলেও তার কোনো পদ-পদবীর তথ্য আমরা পাওয়া যায়নি। সে নিজেকে বিশ্বস্ত করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ছবি তুলত। সব ছবি তুলতে পেরেছে তাও নয়, কিছু ক্ষেত্রে ছবি এডিট করে ফেসবুকে শেয়ার করেছে।
তিনি বলেন, আটক মনসুর প্রথমে স্থানীয় এলাকায় জমির দালালি করত। পরে ঢাকায় একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকাকালীন এভাবে প্রতারণার বিষয়টি তার মাথায় আসে। এক পর্যায়ে কর্মচারীর মাধ্যমে সাইফুলের সঙ্গে পরিচয় হলে প্রতারণার জন্য চক্রটি গড়ে তোলে। আটক মহসিন প্রথমে ঢাকার মালিবাগে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির ব্যবসা করত। ব্যবসায়িক ক্ষতির কারণে ফ্যাক্টরি বিক্রি করে দিয়ে মতিঝিলে মনসুরের সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে এই প্রতারক চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়।