পটুয়াখালীর সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য কাজী কানিজ সুলতানা হেলেনের ছেলের বরযাত্রীর গাড়ির টোল চাওয়ায় গত বৃহস্পতিবার পায়রা সেতুর টোল আদায়কারীদের মারধরের ঘটনা ঘটেছে। এরপর টোল না দিয়েই তারা চলে যায়। এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হয়।

সর্বশেষ গত শুক্রবার বিনা টিকেটে ভ্রমণের দায়ে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের স্ত্রী শাম্মি আক্তার মনির তিন আত্মীয়কে জরিমানা করায় মন্ত্রীর স্ত্রীর নির্দেশে রেলের টিকেট পরীক্ষক (টিটিই) শফিকুল ইসলামকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। যদিও সমালোচনার মুখে রোববার এই আদেশ প্রত্যাহার করে নেয় রেল কর্তৃপক্ষ। ক্ষমতাসীন দলের এমপি-মন্ত্রীর ছেলে, স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনদের ক্ষমতার দাপটের এমন চিত্র বিভিন্ন সময় প্রায় সারা দেশেই দেখা যায়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘ক্ষমতার দাপট’ কয়েক যুগ ধরেই চলে আসছে। জবাবদিহিতার অভাবে এটা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। যে দল যখনই ক্ষমতায় থাকে তারা মনে করে আইন-আদালত তাদের জন্য নয়। প্রশাসনও ওই ক্ষমতাবানদের সহযোগী হিসেবে পরিণত হয়।

বিনা টিকেটে ভ্রমণের অপরাধে জরিমানা করায় রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর আত্মীয়কে জরিমানা করায় টিটিইকে বরখাস্ত করার ঘটনা সারা দেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। টিটিইকে বরখাস্তের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন রেলমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মি আক্তার। তার নির্দেশে মূলত টিটিইকে বরখাস্ত করা হয়। এ ঘটনার পর মন্ত্রী-এমপির আত্মীয়স্বজনদের ক্ষমতার দাপটের বিষয়টি ফের আলোচনায় আসে।

এর আগে ঢাকার সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের দাপটের খবরও দেশব্যাপী আলোচিত হয়েছিল। ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর রাতে তিনি ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধর করে কারাগারে গেলেও তাকে বেশিদিন আটকে রাখা যায়নি। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে তখন তিনটি মামলা হলেও এরই মধ্যে অস্ত্র ও মাদক মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

আর সম্প্রতি তার বাবা সংসদ সদস্য হাজী সেলিম ১০ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে আত্মসমর্পণের বিষয়ে আদালতের আদেশ থাকা সত্ত্বেও বিনা বাধায় থাইল্যান্ড থেকে ঘুরে এসেছেন। পুলিশ বা ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ কেউ তাকে আটকায়নি। এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে বধিরদের জমি দখলের অভিযোগও রয়েছে।

অন্যদিকে ২০১৮ সালের ১৯ জুন রাতের ফাঁকা সড়কে নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে সাবাব চৌধুরীর বেপরোয়া গতির গাড়ি কেড়ে নিয়েছিল পথচারীর প্রাণ। বিলাসবহুল ‘অডি’কার নিয়ে বনানী থেকে মহাখালী ফ্লাইওভারে উঠতে গিয়েই চাপা দিয়েছিল পথচারীকে। সংসদ সদস্যের স্টিকার যুক্ত ওই গাড়ি চালাচ্ছিলেন সাবাব চৌধুরী। পরে অবশ্য নিহতের পরিববারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে রেহাই পান এমপিপুত্র। এরপর তিনি ২০২০ সালের ১৩ জুলাই চট্টগ্রামে পুলিশের একটি গাড়িকে ধাক্কা দিয়েছিলেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল রাতে সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আহমেদ রনি ইস্কাটন এলাকায় মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে দুজনকে হত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছে।

এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ও আলোচিত সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ভাইয়ের ছেলে আজমেরি ওসমানের বিরুদ্ধে ত্বকী হত্যায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠলেও ক্ষমতার দাপট থাকায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করা যাচ্ছে না বলে জানা গেছে। আর শামীম ওসমানের ভাই সেলিম ওসমান স্কুল শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠবস করানোর পর চাকরিও হারাতে হয় ওই শিক্ষককে।

কয়েক মাস আগে দাপট দেখাতে গিয়ে প্রতিমন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন ডা. মুরাদ হাসান। সর্বশেষ তার বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন তার স্ত্রী। কিন্তু পুলিশ এই আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে জানা গেছে। বরগুনার আলোচিত রিফাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নানা প্রসঙ্গে এসেছিল স্থানীয় সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুমন দেবনাথের নাম। দেশের তরুণ সমাজ ধ্বংসকারী মাদক ইয়াবা চোরাচালানের ‘অঘোষিত গডফাদার’ নামে বহুল আলোচিত একজন সাবেক এমপি এবং তার পাঁচ ভাই। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গোপন প্রতিবেদনে ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে এদের প্রত্যেকের নাম শীর্ষস্থানে থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে।

সবসময়ই যারা যখন ক্ষমতায় থেকেছেন তারা দাপট দেখিয়েছেন। এটা দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি মনে করেন, দাপটের মাধ্যমে প্রশাসনের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ফলে যারা দাপট দেখান তাদের সুরক্ষাও দেওয়া হয়েছে। এটা এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ কৌশল।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘রেলের ঘটনাটি ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি নির্লজ্জ ও নিকৃষ্টতম উদাহরণ। এখানে মূলত দুভাবে ক্ষমতার অপব্যবহারের ঘটনা ঘটেছে। প্রথমত রেলমন্ত্রীর নিকটাত্মীয়দের বিনা টিকেটে রেলভ্রমণ অর্থাৎ তারা ধরেই নিয়েছিল যে, রেলের প্রচলিত আইন তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।’

তিনি বলেন, ক্ষমতার নানা দাপটের মাধ্যমে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করা হচ্ছে। এখন রেলের ঘটনায় ক্ষমতার অপব্যবহারের বিভিন্ন পর্যায়ে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয় তা হলে তো ক্ষমতার এই অপব্যবহার আরও বাড়বে।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার কোনো দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় না, দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে দল ও সরকারের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর ও সুস্পষ্ট। তাই ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অনৈতিক কাজ করলে পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দুর্নীতি ও অপকর্মের বিরুদ্ধে সরকার নিজ দলেরও কাউকে ছাড় দিচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, সুশাসনের স্বার্থে অপরাধী যে-ই হোক তাকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা রয়েছে।

রেল মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সমাজে অবক্ষয় শুরু হলে এর ঢেউ সবখানেই লাগে। কোনো মন্ত্রীর স্ত্রীর নির্দেশনায় কাউকে বরখাস্ত করা গর্হিত অপরাধ। এজন্য যে কর্মকর্তা বরখাস্ত করেছিলেন তাকেই বরখাস্ত করা উচিত।

তিনি বলেন, কোনো সরকারি দফতরে কোনো এমপি, মন্ত্রী বা নেতার পরিবারের কোনো সদস্যের অযাচিতভাবে নাক গলানো উচিত নয়। রাজনীতিবিদদের আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। কারণ সমাজের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। তাই ক্ষমতার দাপট দেখানো বা এমন কোনো কাজ যাতে তারা বা তাদের পরিবারের কোনো সদস্য না করেন যাতে দলের বা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।