রাজধানীর কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠে থানা ভবন হবে নাকি শিশুদের খেলাধুলার জায়গা হিসেবেই থাকবেÑ এখনই এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। মাঠ রক্ষার আন্দোলনের মধ্যেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে দেখা করেছেন পরিবেশবাদী ও অধিকারকর্মীরা। তবে মাঠ হিসেবেই রাখার নিশ্চয়তা পাননি তারা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাফ জানিয়েছেন, এটি পুলিশের সম্পত্তি। খেলার মাঠ শিশুদের ফিরিয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রীকে আজ খোলা চিঠি দেবেন পরিবেশবাদীরা।
এদিকে খেলার মাঠের জায়গা নিয়ে যুক্তিতর্ক চলছেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, ওই স্থানটি কখনও মাঠ ছিল না। তার ভাষায়, আবাসিক এলাকায় ১ বিঘার মতো ওই জমিটি পরিত্যক্ত ছিল, তা এখন পুলিশের সম্পত্তি। মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর পুলিশ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সেখানে থানা ভবনের পক্ষে যুক্তি দেখানোর পরদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও অভিন্ন বক্তব্য দিলেন।
তবে স্থানীয়রা বলছেন, কলাবাগান আবাসিক এলাকায় (পান্থপথের দক্ষিণ পাশে) তেঁতুলতলায় শিশু-কিশোররা যেমন খেলত, তেমনি নানা সামাজিক অনুষ্ঠানও চলে আসছিল। ঈদের জামাতও হতো সেখানে। তারা একে তেঁতুলতলা মাঠ হিসেবেই চেনেন।
সম্প্রতি মাঠটিতে পুলিশ কলাবাগান থানা নির্মাণের কাজ শুরু করলে তার প্রতিবাদে নামে ওই এলাকার বাসিন্দারা। এর জেরে উদীচীর কর্মী সৈয়দা রত্না ও তার কিশোর ছেলেকে ১৩ ঘণ্টা থানায় আটক রাখা পুলিশ। পরে সামাজিক মাধ্যমসহ থানার সামনে বিক্ষোভের পর মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় তাদের।
তেঁতুলতলায় থানা ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধ করতে অধিকারকর্মী ও পরিবেশবাদী খুশী কবির, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্থপতি ইকবাল হাবিব ও সঙ্গীতা ইমাম মঙ্গলবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। বৈঠক থেকে বেরিয়ে খুশী কবির সাংবাদিকদের বলেন, মন্ত্রীকে বলেছি, নির্মাণকাজ বন্ধ করতে। তিনি পুলিশ কমিশনারকে বিষয়টি বলবেন বলে জানিয়েছেন। মন্ত্রীর কথায় খুশী কবির তেমন আশ^স্ত না হলেও পাশে থাকা আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান কিছুটা আশা নিয়ে বৈঠক থেকে ফিরেছেন বলে জানান। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বরাবর আমরা একটি চিঠি দেব। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সেই চিঠি তিনি পৌঁছে দেবেন। বৃহস্পতিবার আমরা চিঠিটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে দেব। এ মুহূর্তে দেয়াল নির্মাণ বন্ধ রাখার জন্য আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি।
এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠকের বিষয়ে বলেন, যেটাকে তেঁতুলতলা মাঠ বলছেন, সেটা কখনও মাঠ ছিল না। এটা গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিত্যক্ত সম্পত্তি ছিল। আমরা শুনেছি, লোকালয়ের পাশে খালি জায়গা, এখানে বাচ্চারা খেলাধুলা করত। একটু আলাপচারিতার জন্য এ জায়গাটি ছিল। এখন সবাই এ জায়গা নিয়ে নানা কথাবার্তা বলছে।
থানা ভবনের গুরুত্ব তুলে ধরে আসাদুজ্জামান কামাল বলেন, ঢাকা শহরে যে নতুন নতুন থানা ভবন হচ্ছে, বেশিরভাগই ভাড়া বাড়িতে। ভাড়া বাড়িতে থাকার কারণে আমাদের পুলিশ ফোর্স নানা ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। সেজন্য এগুলোকে স্থায়ী স্থানে নেওয়ার জন্য আমরা নিয়ম অনুযায়ী জেলা প্রশাসককে ঢাকা শহরের কোনো জায়গায় জমি অধিগ্রহণের জন্য বলেছিলাম। ঢাকার কলাবাগানের কোনো জায়গায় দেওয়া যায় কি না বলেছিলাম। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করে এই জায়গাটি বরাদ্দ দেন। সেই জায়গাটির যে মূল্য তা ঢাকা মহানগর পুলিশ জমা দেওয়ার পর ডিসি জায়গাটি হস্তান্তর করে দিয়ে যান। এটা ছিল মূলকথা।
মন্ত্রী বলেন, আমাদের স্পষ্ট কথা, আমাদের জায়গা প্রয়োজন। কলাবাগানের একটি থানা ভবন প্রয়োজন। সেটার দিকে লক্ষ রেখে আমরা বলছি, এ জায়গাটা আমরা পেয়েছি, এর চেয়ে যদি ভালো, সুইটেবল জায়গা ওখানকার মেয়র সাহেব কিংবা অন্য কেউ যদি ব্যবস্থা করতে পারেন, তখন আমরা সেটা কনসিডার করব। আপাতত আমাদের থানার জন্য এটাই নির্দিষ্ট জায়গা, সরকারিভাবে এটা ব্যবস্থা হয়েছে।
এতকিছুর পরও নির্মাণকাজ চলবে কি না- সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ঘোষণা দেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, নির্মাণকাজ হবে কি হবে না, সেটা পরের কথা। জায়গাটি পুলিশের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। বরাদ্দ যেহেতু হয়েছে সেই জায়গাটি পুলিশের। থানাও জরুরি দরকার, বাচ্চারা যারা কথা বলছে, তাদেরও একটা রিক্রিয়েশন দরকার।
এক প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, এখানে মনে হয় ২০ কাঠা জমি, খুব বড় জমি কিন্তু নয়, ফুটবল খেলার মাঠ এরকমও কিছু নয়, টেনিস খেলার মাঠ হবে দুটো, সে রকমও কিছু নয়। এটা খুবই ছোট জায়গা। এটা আপনারা নিজেরাও বোঝেন। আমিও বলতেছি, আমার থানা দরকার। সেটা তো পাবলিকের বুঝতে হবে। কারণ আমি যদি পাবলিককে সুরক্ষা না দিতে পারি, নিরাপত্তা না দিতে পারে। তখনও তো পাবলিক সেন্টিমেন্ট আমাদের বিপক্ষে আসবে।
মাঠের জন্য আন্দোলনকে যৌক্তিক মনে করছেন কি নাÑ আসাদুজ্জামান কামাল বলেন, কঠিন কঠিন প্রশ্ন করলে তো আমি মুশকিলে পড়ে যাব। আমি বলব, এখন এটা পুলিশের সম্পত্তি। এখন একটি আবেদন আসছে, সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা চিন্তা-ভাবনা করব, এটা কী করা যায়। সীমানা প্রাচীর নির্মাণ স্থগিত রাখার জন্য ডিএমপি কমিশনারকে বলবেন কি নাÑ জানতে চাইলে তিনি এবারও সরাসরি উত্তর এড়িয়ে বলেন, আমি বলেছি, আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করব।
এদিকে থানা ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে রাজধানীর কলাবাগান তেঁতুলতলা মাঠ শিশু-কিশোরদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন মানবাধিকার, পরিবেশ আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। অন্যথায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ঘেরাওসহ কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। বুধবার ওই মাঠে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে এই হুঁশিয়ারি আসে। এরপর মাঠের সীমানা ঘেঁষে ১৪টি দেশীয় গাছ রোপণ করা হয়। পাশাপাশি একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেন আন্দোলনকারীরা।
প্রতিবাদ সমাবেশে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, যারা এখানে খেলে, যারা এ মাঠের প্রকৃত মালিক; তারা এখানে আছে। তারা প্রতিবাদ করছে মাঠ কেন দখল করা হচ্ছে? আমরা সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করছি, সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথাবার্তা হচ্ছে।
পুলিশকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আপনারা যেখানে-সেখানে, যখন খুশি মাঠ নিয়ে নেবেন, পুলিশ যদি এটা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে তা হলে আর মাঠ থাকবে না। আবার বলা হচ্ছে, এখানে যারা খেলত, তারা কলাবাগান মাঠে গিয়ে খেলতে পারবে। কিন্তু কলাবাগান মাঠে তো সবসময় সবাইকে ঢুকতে দেওয়া হয় না।
কোথাও জায়গা না পেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে থানা ভবন নির্মাণের প্রস্তাব দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বুধবার তেঁতুলতলা মাঠে তিনিও প্রতিবাদে সমাবেশে অংশ নিয়ে বলেন, তেঁতুলতলা মাঠ শিশুদের ফুসফুস, বয়স্কদের ফুসফুস, এ ফুসফুস নষ্ট করতে দেওয়া যাবে না। এখানে থানা নির্মাণের অন্যায় অনুমতি পেলেই আমরা মেনে নেব না। এখান থেকে ইট-পাথর সরাতে হবে, না হলে আমরা এখানে আস্তানা গাড়ব।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী কমিটির মহাসচিব নূর খান বলেন, আজকে এত কিছুর পরও আমরা লক্ষ করছি এখানে দেয়াল তৈরি হচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা এক ধরনের অপকৌশল নিচ্ছে। দেয়াল নির্মাণের মধ্য দিয়ে মাঠ ব্যবহার সীমিত হয়ে যাবে। অনতিবিলম্বে সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত আসুক, এটিকে শিশু-কিশোরদের খেলাধুলার মাঠ হিসেবেই বিবেচনা হোক। কোনো গোষ্ঠীকে যেন না দেওয়া হয়, কোনো থানা বা কোনো স্থাপনা যেন তৈরি না হয়।
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার বলেন, তেঁতুলতলা মাঠ শিশু-কিশোরদের ফিরিয়ে দেওয়া না হলে প্রয়োজনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ঘেরাও করা হবে।
তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সৈয়দা রত্না বলেন, আমি এ মাঠ উন্মুক্ত দেখতে চাই। এ মাঠে এলাকার ছেলেমেয়েরা খেলা করবে। মাঠটি শিশুদের জন্য উন্মুক্ত করাই আমার একমাত্র চাওয়া। মাঠে শিশু-কিশোররা খেলতে পারলে আমার আর কোনো অভিযোগ থাকবে না।
পরে ‘আমাদের মাঠে আমরাই খেলব’- এই শিরোনামে মাঠে একটি সাইনবোর্ড টাঙান আন্দোলনকর্মীরা। এতে লেখা রয়েছে- ‘এটি তেঁতুলতলা মাঠ।’ সেখানে ড্যাপের প্রস্তাবিত নকশায় কলাবাগান এলাকার একটি মানচিত্রও রয়েছে, যাতে তেঁতুলতলা মাঠটি মাঠ হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে। সাইনবোর্ডটি প্রচারে শিশু-‘কিশোর ও নাগরিকবৃন্দ লেখা আছে।’
ওই সময় স্থানীয় শিশু-কিশোররা মাঠে উপস্থিত হয়ে ‘মাঠ চাই- মাঠ চাই, দাবি মোদের একটাই’সহ নানা স্লোগান দিতে থাকে।
এত সামাজিক আন্দোলনের পরও এখনও মাঠের দেয়াল গাঁথুনির কাজ চলছে। মাঠের মধ্যে আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সাদা পোশাকেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য মাঠের মধ্যে এবং আশপাশে দেখা গেছ। মাঠের পাশে পুলিশের দুটি ভ্যান দেখা গেছে।