ইউক্রেনে সামরিক অভিযান পরিচালনার কারণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে রাশিয়াকে সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। এই কাজে সফল হতে দরকার সৌদি আরবের সহায়তা। আর তাই তেলের উৎপাদন বাড়াতে সৌদির ওপর চাপ প্রয়োগ করছে বৈশ্বিক পরাশক্তি এই দেশ দু’টি।
তবে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের কথামতো চলতে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি খুব কমই প্রস্তুত। একইসঙ্গে মার্কিন ডলার বাদ দিয়ে চীনা মুদ্রায় চীনের কাছে তেল বিক্রির হুমকিও সামনে এনেছে রিয়াদ।
এই পরিস্থিতিতে বুধবার (১৬ মার্চ) বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ক্রুড ওয়েল রপ্তানিকারক দেশ সৌদি আরবে গেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এর একদিন আগেই অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রেট ম্যাকগার্কের নেতৃত্বে একটি মার্কিন প্রতিনিধি দল দেশটিতে পৌঁছেছে।
বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) এক প্রতিবেদনে বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, তেল উৎপাদনে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দু’টি দেশ হচ্ছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের এই দু’টি দেশকে তেল উৎপাদনের আহ্বান জানিয়েছিল পশ্চিমা দেশগুলো। কিন্তু পশ্চিমাদের সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে দেশ দু’টি।
২০১৮ সালে ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট এবং সৌদি রাজপরিবারের কঠোর সমালোচক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ড ইস্যুতে পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স ও দেশটির কার্যত শাসক মোহাম্মদ বিন সালমান। এছাড়া সৌদির মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং ইয়েমেন যুদ্ধ নিয়েও হরহামেশায় হয় পশ্চিমাদের সমালোচনা। আর এ কারণেই এখন পর্যন্ত এমবিএস নামে পরিচিত এই যুবরাজ্যের সঙ্গে সরাসরি কোনো চুক্তি করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে চলেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।
রয়টার্স বলছে, সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক শীতল হওয়ায় রাশিয়া ও চীনের সাথে সম্পর্ক মজবুত করেছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। এমনকি বেইজিং-মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত হলেও ওয়াশিংটনের সঙ্গে সৌদির এখনও ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা সম্পর্ক রয়েছে।
দু’টি সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তাসংস্থাটি জানিয়েছে, সৌদি আরবে পৌঁছানোর পর গত মঙ্গলবারই দেশটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেন ব্রেট ম্যাকগার্ক ও অন্যান্য মার্কিন প্রতিনিধিরা। এসময় তেল উৎপাদন আরও বাড়াতে এবং ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধ বন্ধে একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছাতে দেশটিকে চাপ দেন তারা।
সৌদির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধিদের এই বৈঠকের ব্যাপারে জ্ঞাত ওই দু’টি সূত্রের একটি রয়টার্সকে জানায়, ‘সৌদি আরবের এই দু’টি (তেল উৎপাদন ও ইয়েমেন যুদ্ধ) ফাইল ওয়াশিংটন ছেড়ে দেবে এমনটা ভেবে থাকলে সেটি ভুল হবে।’
মার্কিন প্রশাসনের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেছেন, ইয়েমেনসহ বিস্তৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেই মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রেট ম্যাকগার্কের নেতৃত্বে ওই মার্কিন প্রতিনিধি দল। তবে এর বেশি বিস্তারিত আর কিছু জানাতে অস্বীকৃতি করেন তিনি।
অন্যদিকে মস্কো ইউক্রেন আক্রমণ করার পরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর চাপ সৃষ্টির এবং রাশিয়ান হাইড্রোকার্বন থেকে বিশ্বকে মুক্ত করার প্রচেষ্টায় সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ইতোমধ্যেই (পশ্চিমাদের) ‘প্রধান আন্তর্জাতিক অংশীদার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।
কিন্তু আরব আমিরাতের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবদুল খালেক আবদুল্লাহ বলছেন, (সৌদি ও আমিরাতের কাছ থেকে) বরিস জনসনের খুব বেশি আশা করা উচিত নয়। টুইটারে দেওয়া এক বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘বরিস খালি হাতেই ফিরে যাবেন।’
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের এই সফরের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে সৌদি সরকার। তবে আপাতত পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংস্থা এবং রাশিয়াসহ মিত্রদের মধ্যকার ওপেক প্লাস নামে একটি তেল সরবরাহ চুক্তি ত্যাগ করার কোনো লক্ষণ দেখায়নি সৌদি আরব।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে গত ২ মার্চ ওপেক প্লাসের সর্বশেষ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পূর্ব ইউরোপে রুশ আগ্রাসনের কারণে পশ্চিমা দেশগুলো মস্কোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা শুরু করলেও ওপেক প্লাসের মন্ত্রী পর্যায়ের ওই বৈঠকে ইউক্রেন ইস্যুটি এড়িয়ে যাওয়া হয় এবং বিদ্যমান নীতি অব্যাহত রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এছাড়া চীনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে রিয়াদ। একইসঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে চলতি বছর সৌদি সফরের আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলেছে, সৌদি আরব কিছু অপরিশোধিত তেল চীনের কাছে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে বিক্রি করার জন্য আলোচনা করছে।
একটি সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স বলছে, সৌদি আরব যদি তা (চীনা মুদ্রা ইউয়ানে তেল বিক্রি) করে তবে সেটি বৈদেশিক মুদ্রার বাজারের গতিশীলতা পরিবর্তন করবে। একইসঙ্গে সৌদি তেলের অন্য ক্রেতারাও এটি অনুসরণ করবে।
সৌদি আরবের জ্বালানি মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। একইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি সৌদি আরামকো গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুতে মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।
একজন কূটনীতিক জানান, পশ্চিমাদের পেছনে ঠেলে দেওয়ার জন্য ‘পুরাতন হুমকির’ দিকে ঝুঁকছে রিয়াদ। যদিও কূটনীতিক ও অন্যরা বলছেন যে, মার্কিন ডলার ছেড়ে তেলের মূল্য ইউয়ানে লেনদেন করতে হলে বাস্তব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।
এছাড়া অপরিশোধিত তেলের দাম ডলারে দেওয়া হলে সৌদি রিয়াল স্থির বা মজবুত থাকে। অন্যদিকে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে একই ভূমিকা পালন করতে পারবে না ইউয়ান।
রয়টার্স বলছে, চলতি বছর জানুয়ারি মাসের শেষে সৌদি আরবের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৪৯২ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সম্পদ ছিল। যার মধ্যে মার্কিন কোষাগারে রক্ষিত আছে ১১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সৌদি সরকারের সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আবুধাবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ মনিকা মালিক বলছেন, সৌদি আরব ধীরে ধীরে কিছু বিক্রয় ইউয়ানে স্থানান্তর করতে পারে। তার ভাষায়, ধীরে ধীরে পরিবর্তনের ফলে প্রভাব হবে সীমিত।
এমনকি গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা যখন রিয়াদে বৈঠক করছিলেন তখনও মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে যে, ওয়াশিংটন তার মিত্রদের যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে বলছে না।
সূত্র : রয়টার্স