সিএনএম ডেস্কঃ
বৈশ্বিক মহামারি করোনার (কোভিড-১৯) দ্বিতীয় ও তৃতীয় আঘাতের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট অর্থনৈতিক অভিঘাত সফলভাবে মোকাবলা করে চলমান উন্নয়ন বজায় ও উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য সামনে রেখে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট আজ সংসদে পেশ করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ( ৩ জুন) জাতীয় সংসদে ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যত পথপরিক্রমা’ শ্লোগান সম্বলিত এ বাজেট পেশ করেন। তিনি পাওয়ার পয়েন্টে প্রস্তাবিত বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ দিক, সরকারের পদক্ষেপ এবং বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ প্রস্তাব তুলে ধরেন।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং এনবিআর বহির্ভূত সূত্র থেকে কর রাজস্ব ধরা হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। কর বহির্ভুত খাত থেকে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা দেখানো হয়েছে, যা জিডিপির ৬.২ শতাংশ। এ ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক সূত্র থেকে ১ লাখ ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা আহরণ করা হবে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক বহির্ভূত উৎস থেকে ৩৭ হাজার ১ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭.২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি ৫.৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।
এর আগে আজ দুপুরে সংসদ ভবনের মন্ত্রিসভা কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের সভায় প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন করা হয়। এরপরই রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ প্রস্তাবিত বাজেটে অনুস্বাক্ষর করেন।
এছাড়াও, অর্থমন্ত্রী আজ ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকার সংশোধিত বাজেট পেশ করেন। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেট ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর এটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের এ মেয়াদের তৃতীয় বাজেট। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালেরও তৃতীয় বাজেট। আর বাংলাদেশের ৫০তম বাজেট। বৈশ্বিক মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে এবার সংক্ষিপ্ত পরিসরে বাজেট পেশ করা হয়। বাজেট পেশের সময় সংসদ সচিবালয়ের ক্যালেন্ডার অনুযায়ি ১শ’ থেকে ১১০ জন সংসদ সদস্য বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। অধিবেশন কক্ষে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আসন বিন্যাস করা হয়।
অর্থমন্ত্রী বিকেল ৩টা ৪ মিনিটের দিকে বাজেট বক্তৃতার শুরুতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের অন্যান্য শহীদ, চার জাতীয় নেতা, মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা, নির্যাতিতা ২ লাখ মা বোন এবং অন্যান্য শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এছাড়া তিনি বৈশ্বিক মহামারি কোভিড- ১৯ আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারানো সকলের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে। করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানসমূহ পুনর্বিন্যাস করে জনসমাগম এড়িয়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে উদযাপন করা হচ্ছে। এ বছর (২০২১ সাল) হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠান যুগপৎভাবে উদযাপিত হচ্ছে। তিনি বলেন, এ উদযাপনের লক্ষ্য হচ্ছে জাতির জীবনে নতুন জীবনীশক্তি সঞ্চারিত করা, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে জাতিকে নতুনমন্ত্রে দীক্ষিত করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নের পথে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সংসদে প্রেসিডেন্ট বক্সে বসে বাজেট বক্তৃতা শোনেন এবং অধিবেশন কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেন।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, বিগত ১২ অর্থ বছর ধরে দেশে উন্নয়নের ধারাবাহিকতার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির আঘাতে অদ্যাবধি দেশে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও অর্থননৈতিক অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃঢ় ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে জীবন ও জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সরকার দেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় করোনা মহামারির ফলে আর্থিক ক্ষতি মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপের কথা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন।
প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের জনপ্রশাসন খাতে ১৮.৭ শতাংশ ও ১৫.৭ শতাংশ, পরিবহন- যোগাযোগ খাতে ১১.৯ শতাংশ, সুদ খাতে ১১.৪ শতাংশ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাতে ৭ শতাংশ, ভর্তুকী ও প্রণোদনা খাতে ৬.৮ শতাংশ, জনপ্রশাসন খাতে ৬.৭ শতাংশ, প্রতিরক্ষা খাতে ৬.২ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাতে ৫.৪ শতাংশ, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে ৫.৭ শতাংশ, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা খাতে ৪.৮ শতাংশ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ৪.৫ শতাংশ, কৃষি খাতে ৫.৩ শতাংশ, গৃহায়ন খাতে ১.১ শতাংশ, বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম খাতে ০.৮ শতাংশ, শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিস খাতে ০.৭ শতাংশ এবং বিবিধ ব্যয় খাতে ০.৮ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে এবার স্বাস্থ্য খাতে করোনা মোকাবেলায় ১০ হাজার কোটি টাকা আলাদাভাবে থোক বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়।
প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা, যোগাযোগ অবকাঠামো, ভৌত অবকাঠামো, আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, কৃষি, মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।