সিএনএম ডেস্কঃ
আব্রাহাম [ইব্রাহিম]-কে ইয়াহওয়েহ [আল্লাহ] প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তাঁর সন্তানদিগকে কেনান [ইজরায়েল] দান করবেন; অর্থাৎ, কেনান জনপদের মালিক হবেন আব্রাহাম (আ.)-এর বংশধরেরা।
আব্রাহাম (আ.)-এর দুইপুত্র ইসমাইল ও আইজ্যাক [ইসহাক]। ঘটনাক্রমে শিশু ইসমাইল (আ.) এবং তাঁর মাকে মক্কার মরুভূমিতে রেখে যান পিতা আব্রাহাম। কেনানে রয়ে যান আইজ্যাক (আ.)। আইজ্যাক (আ.)-এর পুত্র জ্যাকব [ইয়াকুব]। জ্যাকব, অর্থাৎ ইয়াকুব (আ.)-এর আরেক নাম ইজরায়েল। ইজরায়েল (আ.)-এর নামানুসারে কেনান জনপদের নামকরণ করা হয় ইজরায়েল। এবং তাঁর সন্তানেরাই ইজরায়েল জাতি।
ইজরায়েল (আ.)-এর বার জন পুত্র ছিল। পুত্রদের মধ্যে যোসেফ [ইউসুফ] নবী ছিলেন অন্যতম। শিশু যোসেফ (আ.) তাঁর এগারো ভাইয়ের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ঘটনাক্রমে মিশরে যান। সেখানে গিয়ে বাদশার অর্থমন্ত্রী আজিজের ডান হাত এবং তাঁর স্ত্রী জুলেখার প্রেমিক হোন। আমরা জুলেখা প্রসঙ্গে যাবো না। যোসেফ (আ.) যখন ক্ষমতার সিংহাসনে বসা, তখন দুর্ভিক্ষপীড়িত ভাইয়েরা তাঁর কাছে সাহায্যের জন্য মিশরে এসেছিলেন।
কালের পরিক্রমায় আব্রাহাম, আইজ্যাক, ইজরায়েল ও যোসেফ (আ.)-এর বংশধরেরা মিশরের ফেরাউনের দাসে পরিনত হয়!
রাজপ্রাসাদের ভোগবিলাস পরিত্যাগ করে নির্যাতিত ইজরায়েল জাতির নেতা হিসেবে আবির্ভূত হোন মোজেস ; আমরা মুসলিমরা যাঁকে মুসা নবী বলি। মোজেস (আ.)-এর উপর তাওরাত অবতীর্ণ হয়। তাঁর অনুসারীরা পৃথিবীর বুকে ইহুদি জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে ইজরায়েলে সমবেত হয় ইহুদিরা।
মোজেস (আ.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর অবর্তমানে অধিকাংশ ইহুদিরা মৌলবাদে জড়িয়ে পড়ে। এবং বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে যায়।
জেরুজালেমের কাছেই বাস করতেন যোহন [ইয়াহিয়া] নবীর পিতা জাকারিয়া (আ.)। যোহন (আ.)-এর খালাতো বোন মেরি [মরিয়ম] জাকারিয়া (আ.)-এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। বিয়ের আগেই মেরি (আ.) গ্যাবরিয়েল [জিবরাইল] মারফত জানতে পারেন যে, তিনি স্বামী ছাড়াই গর্ভবতী হবেন! অতঃপর জন্ম দেন যিশুখ্রিস্টকে। মৌলবাদীদের হাতে ছিনতাই হওয়া ইহুদি ধর্মদর্শনকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ত্রানকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হোন যিশুখ্রিস্ট, যাঁকে আমরা ঈসা (আ.) বলি। তিনিই পুনরায় ইহুদিদের কেনানে (ইজরায়েলে) জড়ো করেন। কিন্তু, ইহুদি মোল্লাদের হাতে নিহত হোন (অবশ্য ইসলাম বলে যিশুখ্রিস্ট এখনো বেঁচে আছেন)। যিশুখ্রিস্টের উপর ইঞ্জিল শরিফ নাযিল হয়।
ইজরায়েলের প্রথম রাজা ছিলেন সল [তালুত]। সল-এর সেনাপতি ছিলেন ডেভিড, আমরা মুসলিমরা যাঁকে দাউদ (আ.) হিসেবে জানি। ডেভিড (আ.) সল এর সেনাবাহিনী থেকে সুনাম অর্জন করেন। এবং পরবর্তীতে রাজা হোন।
ডেভিড (আ.)-এর মৃত্যুর পর পুত্র সলোমন অর্থাৎ সুলাইমান (আ.) ইজরায়েলের রাজা হোন এবং তিনিই জেরুজালেমে টেম্পল অফ সলোমন নির্মাণ করেন, আমরা যেটাকে বাইতুল মুকাদ্দাস বলি।
সলোমন (আ.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রেহোবাম ক্ষমতায় আসেন। রেহোবামের সময় ব্যবিলন সাম্রাজ্য ইজরায়েল আক্রমণ করে এবং ইহুদিদের বন্দী করে। ধুলোয় মিশিয়ে দেয় ইজরায়েল রাষ্ট্রকে।
বহুকাল শাস্তি ভোগের পর পারস্যের (আধুনিক ইরানের) জরথুস্ত্রীয় ধর্মাবলম্বী রাজা সাইরাস ব্যবিলনীয়দের হাত থেকে ইহুদিদের মুক্ত করেন; কুরআনে যাঁকে জুলকারনাইন, এবং বাইবেলে যাঁকে মেসিয়াহ বলা হয়েছে।
রাজা সাইরাসের সহযোগিতায় মুক্ত হয়ে আবারও ইহুদিরা ইজরায়েলে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে থাকে। তাঁদের মাঝে আসে নবী দানিয়েল (আ.)। দানিয়েল (আ.) পুনরায় মুকাদ্দাস নির্মাণ করেন।
এরপর নবী এজ্রা [উজাইর] এবং হিজকিল [এজকিয়েল]-এর নেতৃত্বে ইহুদিরা ভালোর দিকে যায়।
৬৩ সালে রোমান জেনারেল পম্পেই ইজরায়েল দখল করে। ৬৬ সালে রোমান সরকারের বিরুদ্ধে ইহুদিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। পরিণামে ১ মিলিয়ন ইহুদির প্রাণ যায়!
১৩১ সালে সম্রাট হাদ্রিয়ান ইহুদি ধর্ম নিষিদ্ধ করে। জেরুজালেমের নাম রাখে ইলিয়া কাপিতোলিনা। বাইতুল মুকাদ্দাসকে বানায় জুপিটার মন্দির। আর ইজরায়েলের নাম পরিবর্তন করে রাখে প্যালেসটাইন [ফিলিস্তিন]।
৪ শতকে সম্রাট কনস্টান্টিনোপল খ্রিস্টান ধর্মকে জাতীয় ধর্ম হিসেবে জারি করে। এসময় ইহুদিরা আরো ভয়াবহ বিপর্যের মুখে পড়ে।
৬১১ খ্রিস্টাব্দে ইজরায়েল পারস্যের (ইরানের) অধিনে চলে যায়। ৬২০ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের অন্ধকারে মক্কা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাসে যান। সেখানে নামাজ আদায় করেন। এবং ওখান থেকেই মেরাজে যান। ৬৩৪ সালে মুসলিমরা জেরুজালেম দখল করেন। তাঁরা ৬৯১ সালে সোনালী গম্বুজ এবং ৭০৫ সালে মাসজিদুল আকসা নির্মাণ করেন। ইজরায়েলে তারা খেলাফত আন্দোলন কায়েম করেন। দেদারসে ইহুদিদের ধর্মান্তরিত করে মুসলমান বানান।
১০৯৯ সালে আবার খ্রিস্টানরা মুসলমানদের হাত থেকে জেরুজালেম সহ ইজরায়েল দখল করে। এসময় ইহুদিরা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
১১৮৭ সালে সুলতান আইয়ুবির নেতৃত্বে মুসলমানরা খ্রিস্টানদের হাত থেকে ইজরায়েলকে আবারও ছিনিয়ে নেয়। মুসলমানদের হাতে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ইহুদিরা রোম, পোল্যান্ড ও অটোমান সাম্রাজ্যে – রাশিয়ায় আত্মগোপনে চলে যায়। ১৫৩৮ সালে সুলতান সুলেমান ওয়াল অফ জেরুজালেম নির্মাণ করেন।
এরপর ব্রিটিশদের নজরে আসে আরববিশ্ব।
১৮৮২ সালে রাশিয়ান ইহুদিরা ‘জায়ন’ আন্দোলন গড়ে তোলে। জায়নবাদীরা জায়োনিস্ট আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের পবিত্র ভূমি ইজরায়েল ফিরে পাবার এবং হিব্রু ভাষাকে জীবিত করার স্বপ্ন দেখতে থাকে।
১৮৯৬ সালে ইউরোপীয় ইহুদি বিদ্বেষের সমাধান খুঁজতে তাঁরা একটা ইহুদি রাষ্ট্রের চিন্তা মাথায় আনে। ১৮৯৭ সালে জায়োনিস্ট কংগ্রেসে লক্ষ ধার্য্য করা হয়- বাপদাদার ভিটেমাটি ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমি প্যালেস্টাইনেই ইহুদি রাষ্ট্র কায়েম হবে। ১৯০২ সালে ৩৫ হাজার এবং ১৯১৪ সালে ৪০ হাজার ইহুদি প্যালেস্টাইনে চলে আসে। ব্রিটিশ আর ফ্রেন্স ব্যুরোক্রেটরা আরববিশ্ব তথা মধ্যপ্রাচ্যের সীমানা নির্ধারণ করে। ১৯২৩ সালে ৪০ হাজার এবং ১৯২৯ সালে আরো ৮২ হাজার ইহুদি চলে আসে প্যালেস্টাইনে। ১৯৩৩ সালে ন্যাৎসিদের চুক্তিতে ৫০ হাজার এবং ১৯৩৮ সালে আরো আড়াই লাখ আসে!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির হিটলার বাহিনীরা ৬ মিলিয়ন ইহুদি নিধন করে!
১৯৪৭ সালের ১৫ মে গঠিত হয় United Nations special committee on Palestine. যা পরে প্রস্তাব করে:
স্বাধীন এক আরব রাষ্ট্র,
স্বাধীন এক ইহুদি রাষ্ট্র,
এবং জেরুজালেম শহর।
অর্থাৎ প্যালেসটাইন বা ফিলিস্তিন মুসলমানদের জন্য আলাদা একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হবে, ইহুদিদের জন্য স্বাধীন ইজরায়েল হবে এবং জেরুজালেম শহর থাকবে সবার। এই প্রস্তাব ইহুদিরা মানলেও মুসলমানরা প্রত্যাখান করে!
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশরা ইজরায়েল ছেড়ে চলে যায়। এবং তেল আবিব মিউজিয়ামে ইহুদিরা ইজরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা করে। সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের যোসেফ স্টালিন ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু আরবলীগ তা প্রত্যাখান করে।
সেই থেকে শুরু….।
ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েলের নাম নিশানা উড়িয়ে দেওয়ার জন্য আরববিশ্ব একের পর এক হামলা করে আসছে। মুসলমানরা যতোবার হামলা করে, ততবার ইহুদিরা পাল্টা হামলা করে, মুসলিম মারে, এবং জমি উদ্ধার করে!
ওঁরা থাকুক। পৃথিবীর মানচিত্রে যেখানে ৫৭টা মুসলিম রাষ্ট্র, সেখানে একটা ইহুদি রাষ্ট্র থাকলে সমস্যা কি? এই ইজরায়েলকে ঈশ্বর ইহুদিদের দিবেন- এটা ওয়াদা। ঈশ্বর যাঁকে ইচ্ছে তাঁকে ক্ষমতা দান করেন। ১৬০ কোটি মুসলমান মাত্র ১ কোটির কিছু বেশি ইহুদিদের ধ্বংস কামনায় রাতদিন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, আল্লাহ শুনেও শুনেন না! এতেও কি আমাদের কানে পানি যায় না?
লাঞ্ছনা বঞ্চনা বৈষম্য নির্যাতন আর ঘৃণার আগুনে পোড়া ইহুদিরা স্বয়ংসম্পূর্ণ! শিক্ষা, চিকিৎসা, জ্ঞানবিজ্ঞান, সমরনীতি আর গোয়েন্দা নীতিতে তাঁরা বিশ্বসেরা! তাঁদের হাতে যে ক্ষমতা আছে, ইচ্ছে করলে মধ্যপ্রাচ্যের সব মুসলিম রাষ্ট্রকে ধূলিসাৎ করে দিতে পারে! এর প্রমান ইজরায়েল ৬ দিনের যুদ্ধে দিয়েছিল।
ইহুদিরা চায় ইজরায়েল এবং ফিলিস্তিন দুইটা স্বাধীন রাষ্ট্র হোক, জেরুজালেম শহর সবার থাকুক। কিন্তু; মুসলিমরা চায় পুরো জেরুজালেম নিয়ে নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র। মুসলমানদের চাওয়া ইহুদিরা মেনে নিলে, পৃথিবীর বুকে কোনো ইহুদি রাষ্ট্র থাকবে না; ইহুদি জাতির বিলুপ্তি ঘটবে। তা-ই ইজরায়েল সার্বভৌমত্ব রক্ষা প্রতিটা ইহুদির ঈমানি দায়িত্ব। এজন্য ইহুদিরা নারী হোক পুরুষ হোক তাঁদের জন্য মিলিটারি ট্রেনিং বাধ্যতামূলক। ইজরায়েলের প্রতিটা ইহুদি একেকটা মিলিটারি। ওঁরা যুদ্ধকে মেনে নিয়েছে। কারণ- যুদ্ধটা ওঁদের অস্তিত্বের লড়াই।
আর ইহুদিদের ধ্বংস কামনাই যদি হয়ে উঠে মুসলমানদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য, তাহলে মুসলমানদের খানকাহ এবং মসজিদ ছেড়ে চলে যেতে হবে ল্যাবরেটরিতে; মোনাজাতে সময় ব্যয় না করে গবেষণায় মনোযোগ দিতে হবে; এক বই বারবার না পড়ে প্রচুর বই পড়তে হবে; আবেগ ছেড়ে বিবেক দিয়ে কাজ করতে হবে; এবং শিয়া, সুন্নি, অহাবি, খারেজি, আশারিয়া, গাবারিয়া, মালামতিয়া, সাত ইমামি, ইসনা ইমামী, শরিয়তপন্থি, মারেফাত পন্থি, মোল্লা হুজুর ফকির আর আহমদিয়া মুহাম্মদিয়া ইত্যাদি কওম প্রথা ভুলে যেতে হবে।
##সংগৃত##