যুক্তরাষ্ট্র থেকে পালিয়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যোগ দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই নেতৃত্বের উচ্চ পর্যায়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। গোষ্ঠীটির শত শত নারী জঙ্গিসদস্য তার কাছ থেকেই অস্ত্র চালানো ও হামলার প্রশিক্ষণ নিয়েছে।
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের একটি আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় আইএসে যোগদান, গোষ্ঠীটিতে নিজের অবস্থান ও এ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য দিয়েছেন মার্কিন নাগরিক অ্যালিসন ফ্লুক-এক্রেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে মার্কিন সেনাদের হাতে বন্দি হওয়ার আগ পর্যন্ত আইএসের অঘোষিত রাজধানী রাক্কাভিত্তিক নারী ব্যাটালিয়ন খাতিবাহ নুসায়বাহর প্রধান ছিলেন অ্যালিসন তিনি ।
৪২ বছর বয়সী ফ্লুক-এক্রেনের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্য কানসাসে। জীববিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে স্কুল শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছিলেন তিনি। আইএসে যোগ দিতে ২০১১ সালে সিরিয়ার উদ্দেশে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করেন ফ্লুক-এক্রেন।
আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে ফ্লুক-এক্রেন জানান, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রথমে লিবিয়া যান তিনি, তারপর সেখান থেকে সিরিয়া গিয়ে আইএসে যোগ দেন। আন্তর্জাতিক এই জঙ্গিগোষ্ঠীতে যোগ দেওয়ার পর নিজের নাম পাল্টে নতুন নাম নেন মনিকের উমম মোহাম্মেদ আল-আম্রিকি।
আইএসে যোগ দেওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যেই বন্দুক চালানো, গ্রেনেড ছোড়া ও বোমা হামলা দক্ষ হয়ে ওঠেন অ্যালিসন ফ্লুক-এক্রেন। দক্ষতা ও গোষ্ঠী নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যের কারণে আইএসে তার পদন্নোতিও হতে থাকে দ্রুত।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য বলছে, আইএসের মিশর, ইরাক ও তুরস্ক শাখায় কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে ফ্লুক-এক্রেনের। এই তিন দেশের শতাধিক নারী ও কিশোরি জঙ্গিসদস্যকে একে ৪৭ রাইফেল চালানো, গ্রেনেড ছোড়া ও সুইসাইড ভেস্ট প্রস্তুত ও তা ব্যবহারের বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ১০-১১ বছর বয়সী কিশোরীরাও ছিল তার প্রশিক্ষণ দলের মধ্যে। তারপর ২০১৬ সালে রাক্কাভিত্তিক আইএস নারী ব্যাটালিয়ন খাতিবাহ নুসায়বাহর প্রধান হন।
মঙ্গলবার আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে সব তথ্য ও অভিযোগ স্বীকার করেছেন ফ্লুক-এক্রেন। তবে তিনি দাবি করেছেন, কিশোরী বাহিনী গড়ে তোলার কোনো পরিকল্পনা আইএসের ছিল না। পাশাপাশি তিনি আরও জানান, ২০১৯ সালে যখন থাকে গ্রেপ্তার করা হয়— সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে হামলার পরিকল্পনা করছিল ইসলামিক স্টেট; এবং হামলার লক্ষ্যস্থল হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছিল দেশটির বিশ্ববিদ্যালয় ও শপিং মলসমূহকে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ফ্লুক-এক্রেন যে কেবল নারী ও কিশোরীদের অস্ত্রচালনা শেখাতেন, তা নয়; বিভিন্নভাবে নারী জঙ্গিসদস্যদের অনুপ্রাণিত-উদ্দীপ্তও করতেন ফ্লুক-এক্রেন। তাদেরকে তিনি বোঝাতেন ইসলামিক স্টেটের টিকে থাকা ও বিস্তারের জন্য নারী জঙ্গিসদস্যরা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ।’
যেসব নারী ও কিশোরীকে তিনি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, তাদের মধ্যে বেশ কয়েক জন মার্কিন নাগরিক রয়েছেন। তাদের কয়েক জনকে বন্দি করে আদালতে সমর্পণ করেছে মার্কিন বাহিনী। আদালতকে তারা জানিয়েছেন, আইএসের নীতি ও নেতৃত্বের প্রতি ব্যাপকভাবে অনুগত ছিলেন ফ্লুক-এক্রেন। একই সঙ্গে অত্যন্ত নির্মমও ছিলেন তিনি।
তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন— এমন একজন আইএস কর্মী আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় বলেছেন, ‘নিষ্ঠুরতা ও আইএসের প্রতি আনুগত্যের হিসেবে দশের মধ্যে এগার কিংবা বারো পাওয়ার মতো যোগ্যতা রাখেন ফ্লুক-এক্রেন। কোনো হামলায় যদি নিহতের সংখ্যা কম হতো, তাহলে তাকে তিনি আইএসের সম্পদের অপচয় বলে গণ্য করতেন।’
গোয়েন্দা তথ্য থেকে আরও জানা যায়, সিরিয়ায় গিয়ে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন এবং তার দ্বিতীয় স্বামী আইএসের সহযোগী জঙ্গিগোষ্ঠী আনসার আল শারিয়ার সদস্য ছিলেন। ২০১২ সালে লিবিয়ার বেনগাজি শহরের মার্কিন ঘাঁটিতে যে হামলা হয়েছিল, তার নেতৃত্বে ছিলেন ফ্লুক এক্রেনের দ্বিতীয় স্বামী। পরে মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলায় নিহত হন তিনি।
মার্কিন বিচার বিভাগসূত্রে জানা গেছে, যেহেতু তিনি দোষ স্বীকার করেছেন— তাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার কমপক্ষে ২০ বছর কারাদণ্ড হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চলতি বছর ২৫ অক্টোবর রায় ঘোষণা করবেন আদালত।
এদিকে এক প্রতিবেদনে বিবিসি জানিয়েছে, ফ্লুক-এক্রেনের বিচার চলাকালে তার সঙ্গে তার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন ভার্জিনিয়ার আদালত।
আর আদালতের আইনজীবীরা বিবিসিকে বলেছেন, তার পরিবারের সদস্যরা ইতোমধ্যে তাকে ত্যাগ করেছেন এবং ২৫ অক্টোবর আদালত রায় দেওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে ত্যাজ্য করে বিবৃতি প্রদান করার পরিকল্পনা রয়েছে ফ্লুক-এক্রেনের স্বজনদের।