চারদেশীয় জোট কোয়াডের শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে মঙ্গলবার টোকিওতে জড়ো হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের নেতারা। এই জোট বা গ্রুপটি আসলে কী, কোথা থেকে এসেছে এবং কেন কূটনীতিকরা বিভিন্ন অংশীদারিত্বের জন্য অদ্ভুত নাম নিয়ে আসছেন?
কোয়াড কী?
আনুষ্ঠানিকভাবে কোয়াড মূলত চতুর্পক্ষীয় নিরাপত্তা সংলাপ। ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরে বিধ্বংসী সুনামির পর একটি আলগা অংশীদারিত্ব গ্রুপ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল কোয়াড। বিধ্বংসী সেই সুনামির পর যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারত; এই চারটি দেশ ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে মানবিক ও দুর্যোগ সহায়তা প্রদানের জন্য একত্রিত হয়েছিল। এরপর ২০০৭ সালে জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে কোয়াডকে একটি আনুষ্ঠানিক রূপ দেন।
কিন্তু এরপর থেকে প্রায় এক দশক এটি সুপ্ত বা অনেকটা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় ছিল। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার উদ্বেগের কারণেই চারদেশীয় এই জোটটি ছিল নিষ্ক্রিয়। কারণ সেসময় অস্ট্রেলিয়া মনে করতো, এই গ্রুপে তাদের অংশগ্রহণ হয়তো চীনকে বিরক্ত করবে।
এরপর ২০১৭ সালে এই গ্রুপটির পুনরুত্থান হয়। এতে করে মূলত এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের প্রতি পরিবর্তনশীল মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটে। সেই সময় থেকে প্রথমে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং পরে জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসন ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের আক্রমণাত্মক বা দৃঢ় পদক্ষেপের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে নজরদারি চালাতে কোয়াডকে মূল চাবিকাঠি হিসেবে ব্যবহার করছেন। কোয়াড নেতারা ২০২১ সালে তাদের প্রথম আনুষ্ঠানিক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করে এবং মার্চ মাসে তারা ভার্চ্যুয়ালি আবারও বৈঠক করে।
কোয়াড কি ‘এশিয়ান ন্যাটো’?
চীন অভিযোগ করেছে যে, এই গ্রুপটি নিজেকে ‘এশীয় ন্যাটো’ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। যদিও মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর মতো কোয়াডের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে কোনো পারস্পরিক-প্রতিরক্ষা চুক্তি কার্যকর নেই। একইসঙ্গে কোয়াডের সদস্য রাষ্ট্রগুলো বলছে, চারটি সদস্য দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক সম্পর্ক আরও গভীর করাই তাদের এই গ্রুপের উদ্দেশ্য।
তবে কোয়াডের একটি পরোক্ষ উদ্দেশ্যও রয়েছে। মূলত কোয়াডের সদস্য দেশগুলো স্পষ্টভাবে না বললেও নিজেদের এই পারস্পরিক অংশীদারিত্বকে চীনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ হিসাবে বোঝানো হয়ে থাকে। ২০২১ সালের মার্চ মাসে দেওয়া ‘স্পিরিট অব কোয়াড’ বা কোয়াডের রূপরেখার ঘোষণায় নেতারা বলেছিলেন, ‘আমরা বৈচিত্র্যময় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসেছি এবং মুক্ত ও অবাধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য একটি একক দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ।’
সেই ঘোষণায় নেতারা আরও বলেছিলেন, ‘আমরা এমন একটি অঞ্চলের জন্য সংগ্রাম করছি যেটি হবে অবাধ, উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বাস্থ্যকর, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং যেকোনো ধরনের জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থাপনা বর্জিত।’
নতুন মুখ কারা?
মঙ্গলবার চারদেশীয় জোট কোয়াডের এই শীর্ষ সম্মেলনে প্রথমবারের মতো অংশ নিচ্ছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা। গত বছরের অক্টোবর মাসে পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি।
এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবেনিজও মঙ্গলবারের এই সম্মেলনে প্রথমবারের মতো অংশ নিচ্ছেন। অস্ট্রেলিয়ার সাধারণ নির্বাচনের মাত্র দুই দিনের মাথায় এবং কোয়াডের সম্মেলনের মাত্র একদিন আগে অর্থাৎ সোমবার অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন তিনি।
ভারতের কী খবর?
কোয়াডের সদস্য দেশ হিসেবে মঙ্গলবারের এই শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। তবে এমন এক সময়ে মোদি এই সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন, যখন ভারতের সংখ্যালঘুদের ওপর দেশটির বিজেপি সরকারের দমন-পীড়ন এবং কিছু স্বৈরাচারী প্রবণতা নিয়ে ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক তদন্ত বা যাচাই-বাছাইয়ের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি।
এছাড়া অন্য একটি দিক থেকেও কোয়াডের অন্য সদস্যদের তুলনায় মোদির তথা ভারতের অবস্থান বেশ ভিন্ন। যেমন, কোয়াডের অন্য সদস্যরা যখন ইউক্রেনে রাশিয়ার চলমান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং মস্কোর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবেই নিষেধাজ্ঞা আরোপে অংশ নিয়েছে, তখন কিয়েভে আক্রমণ শুরুর পর থেকে রুশ জ্বালানির ক্রয় বাড়িয়েছে ভারত।
অধিকন্তু রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ইউক্রেনে আক্রমণের পর থেকেই খাদ্যের ঘাটতি দেখা দিয়েছে যা বিশ্বজুড়েই মূল্যবৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় বৈশ্বিক পরিস্থিতির কথা মাথায় না রেখে ভারত গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। এর ফলে উত্তেজনাকর এই পরিস্থিতিতে চলমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের সমাধান করা আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
কোয়াডে আর কোনো দেশ যোগ দিতে চায়?
পূর্ব এশীয় রাষ্ট্র এবং জাপানের প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ইতোমধ্যেই কোয়াডে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যদিও মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রুপের সদস্যপদ পেতে নিজেদের কোয়াডের সঙ্গে সামঞ্জস্য করার কথা ভাবছে না সিউল।
এছাড়া চারদেশীয় এই গ্রুপটি ইতোমধ্যেই ‘কোয়াড-প্লাস’ নামে একটি বৈঠকের আয়োজন করেছে। সেখানে দক্ষিণ কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং ভিয়েতনাম অংশ নিয়েছিল। আর এটিই এই অঞ্চলে কোয়াডের ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণ বা অংশীদারিত্বের ভিত্তি তৈরি করতে পারে।
অদ্ভুত নাম কেন?
বার্তাসংস্থা এপি বলছে, কূটনীতিকরা নিজেদের সাহায্য করতে পারেন না। একবার একটি অংশীদারিত্ব শুরু করলে তারা কোয়াড বা এইউকেইউএস (অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের নতুন জোট) এর মতো বিভ্রান্তিকর সংক্ষিপ্ত নাম বরাদ্দ করা প্রতিরোধ করতে পারে না।
আর এ কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এশিয়া সফরের সময় চলতি সপ্তাহে আরেকটি সংক্ষিপ্ত রূপ সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। আর সেটি হচ্ছে আইপিইএফ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত নতুন বাণিজ্য চুক্তির পূর্ণরূপ হচ্ছে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক।