খামার বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে কয়েকটি কুকুর মালিকের সঙ্গে অবস্থান করছে। মালিকের স্ত্রী, কন্যা ও শ্যালিকা একটি ইজিবাইকে করে ফটকের সামনে আসতেই তাদের স্বাগত জানাতে এগিয়ে যায় কুকুরগুলো। বাড়িতে প্রবেশ করা পর্যন্ত পরিবারের সদস্যদের সামনে ও পেছনে ছুটতে থাকে তারা।
একেকটির একেক নাম। মাম্বা, জেমি, জিমি, রিমি, ইভি, জ্যাক, লুসিসহ বিভিন্ন নামে এসব কুকুরকে ডাকা হয়। যার নাম ধরে ডাকা হয়, সে-ই দৌড়ে আসে মালিকের কাছে। এমন প্রশিক্ষণ তাদের দেওয়া হয়েছে, যেন হুকুম তামিল করতে একমুহূর্ত দেরি হয় না।
যেমন পুকুরে কিছু ছুড়ে মেরে মাম্বা নামক কুকুরকে নিয়ে আসার অর্ডার করা হলে দৌড়ে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটে সেই জিনিসটি এনে মালিকের হাতে তুলে দেয়। এসব কুকুরকে ছোট থেকে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়েছে।
এমনই দৃশ্যের দেখা মেলে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার আমভিটা এলাকায় সাদিকুর রহমান গালিবের খুলনা ক্যানেল নামক কুকুরের খামারে। তার খামারের তিন প্রজাতির কুকুরের কোলজুড়ে রয়েছে ১৫টি কুকুরছানা। ৪৫ দিন হলেই এসব ছানা বিক্রিয়যোগ্য হবে। ইতোমধ্যে অনেকেই কুকুর ছানা নেওয়ার জন্য বুকিংও দিয়ে রেখেছেন। আবার কিনতে আসছেন।
প্রবাসে থাকতেন গালিব। দেশে ফিরে ওই জমিতে ৯টি পুকুর কাটেন। সেখানে সাদা মাছ ছাড়েন। শুরু করেন মাছ চাষ। কিন্তু পুকুরগুলোর মাছ পাহারার জন্য প্রয়োজন ছিল পাহারাদার। তাই প্রথমে দেশি কুকুর পোষা শুরু করেন। কিন্তু দেশি কুকুরগুলোকে মানুষ লাঠি নিয়ে তাড়া দিলেই তারা ভয়ে সরে যায়। বিষয়টি দেখে গালিব মনে মনে ভাবলেন দেশি কুকুরের পরিবর্তে তিনি বিদেশি কুকুর পালন শুরু করবেন।
এরপর একটি জার্মান শেপার্ড কুকুর কেনেন তিনি। কিছুদিন পর তার জন্য একটি স্ত্রী কুকুর কেনেন। ৫৪ হাজার টাকার কুকুর দিয়েই যাত্রা শুরু হয় গালিবের। এক বছরের মাথায় একবারে ৯টি বাচ্চা দেয়। বাচ্চাগুলো তিনি বিক্রি করতে বিক্রয় ডট কমে বিজ্ঞাপন দেন। অনেকে আগ্রহ দেখান কুকুরছানা কেনার। দেখলেন একেকটি কুকুরছানা ২০ হাজার টাকা থেকে ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়।
পরে তিনি আরও তিনটি জাতের কুকুর কেনেন। রট ওয়াইলার, লাছা ও স্পিডস জাতের কুকুর কিনে তিনি বাণিজ্যিকভাবেই কুকুর পালনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এখন পর্যন্ত তিনি ৩ শতাধিক কুকুর বিক্রি করেছেন। কুকুরের খামার করে সফল গালিব। তার পরামর্শ ও কুকুর নিয়ে অনেকেই সফলতার পথ খুঁজছে।
গালিব জানান, বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে কুকুর পালনের সুযোগ রয়েছে। কুকুরগুলো অনেকে বাড়ি পাহারার জন্য কিনে থাকেন। কেউ কেউ সখের বসেও কুকুর পোষেন। কুকুরগুলোকে তিনি দুবেলা খাবার দেন। দুপুর ১২টায় একবার এবং সন্ধ্যায় একবার। লবণ ও চিনিবিহীন খিচুড়ি রান্না করে কুকুরগুলোকে খাওয়ানো হয়। বর্তমানে তার খামারে ১০ প্রজাতির ৪৪টি কুকুর রয়েছে।
এ ছাড়া ১৫টি কুকুরের বাচ্চা রয়েছে। কুকুরগুলো বাড়িতে ছাড়া থাকে। অপরিচিত কেউ এলেই তার ওপর হামলা করে। কিন্তু মালিকের শেখানো মতো তাদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করলে কিছুই বলবে না। ওই খামারে সাপ, গুইসাপসহ অন্যান্য বন্য প্রাণীও এসব কুকুরের কারণে আসতে পারে না। কুকুরগুলোর কারণে সেখানে কোন চোর-ডাকাত ঢুকতে পারে না। ইতোমধ্যে স্থানীয় অনেকেই জেনে গেছেন যে ওই বাড়িতে কুকুর আছে। তাই খামারটি অনেকটা নিরাপদ।
গালিব এক ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা। তার রয়েছে দুই তলার দুটি ভবন। পরিবারের সবাইর সাথেই কুকুরগুলোর রয়েছে বন্ধুসুলভ আচরণ। বর্তমানে ১২টি পুকুর, সাদা মাছ ও রঙিন মাছের চাষ, কবুতর পালন, কচ্ছপ ও কুকুরের খামার রয়েছে তার।
খুলনা ক্যানেলের স্বত্বাধিকারী সাদিকুর রহমান গালিব ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাড়ি ও পুকুরের মাছের নিরাপত্তায় দেশি কুকুর পালন শুরু করি। কিন্তু দেশী কুকুর সেইধরনের নিরাপত্তা দিতে পারে না। যে কারণে অনলাইনে স্টাডি করার পর শিখলাম জার্মান শেপার্ড কুকুর প্রভুভক্ত হয় এবং খুব ডিফেন্সিভ হয়। সে কারণে প্রথমে আমার একটা জার্মান শেপার্ড কেনা। তার প্রয়োজনে স্ত্রী কুকুর কিনলাম। এরপর বাচ্চা দিল। কুকুরের প্রতি ভালোবাসা থেকে কুকুরের সংখ্যা বাড়তে থাকি। আস্তে আস্তে এটা কুকুরের ফার্মে রূপান্তর হয়েছে। কুকুর বিক্রি করি। প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছি খুলনা ক্যানেল। এখন সারাদেশে কুকুর সাপ্লাই করছি।
এক জোড়া কুকুর দিয়ে শুরু করে এখন আমার কুকুরের সংখ্যা ৪৪টি। আর স্পিডসেল, ডোবারম্যান ও জার্মান শেপার্ডের মোট ১৫টি বাচ্চা রয়েছে। এ ছাড়া দুটি কুকুর গর্ভবতী রয়েছে। এই মাসে গর্ভবতী হবে আরও ৪-৫টি কুকুর। কুকুরের প্রজাতি এবং খাবার খরচ অনুযায়ী বাচ্চার মূল্য নির্ধারণ করে বিক্রি করা হয়। বাচ্চার বয়স ৪৫ দিন হলে বিক্রি করা হয়। বাচ্চা বিক্রি করে অন্যান্য প্রজাতির কুকুরের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, কুকুরগুলো পরিবারের অংশ হয়ে গেছে। সারা দিন তাদের দেখাশোনা, পুকুরের মাছ, কবুতর পালনে সময় কেটে যায়। কুকুরের খাবার হিসেবে তিনি মাংস দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে দেন। এ ছাড়া বাচ্চা কুকুর ও গর্ভবতী কুকুরের খাবার মেন্যু আলাদা। যারা কুকুর কিনে তাদের পরামর্শ দেওয়া হয়। কীভাবে কুকুর লালন-পালন করবে, কৃমিনাশক ওষুধ দেবে, একটা সুন্দর নাম রাখা ইত্যাদি।
তিনি বলেন, কুকুরের বাচ্চাদের ট্রেনিং দিলে তারা শিখতে পারে। নতুন পরিবেশের সঙ্গে মিশতে পারে এবং যে উদ্দেশ্যে কুকুর নেবে, সেই ট্রেনিং দিলে সফল হওয়া সম্ভব। বিদেশি এসব কুকুর ৩০০ থেকে ৪০০ শব্দ শিখতে পারে। এরা খুবই ইন্টেলিজেন্ট প্রাণী। এদের মুখের কথায় পরিচালনা করা সম্ভব। আমার কাছ থেকে বাচ্চা নিয়ে খুলনার ১০ জনের মতো অলরেডি কুকুর লালন-পালন করছে। এ ছাড়া সারাদেশে ৩ শতাধিক কুকুর তিনি বিক্রি করেছেন বলে জানিয়েছেন।
এদিকে খুলনাসহ দেখের বিভিন্ন স্থানে থেকে তার খামারে আসেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। অনেকে খামার পরিদর্শনে আসেন। আবার কেউ কেউ কুকুরের ছানা কিনতে আসেন।
দৌলতপুরের ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম রতন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গালিব ভাই কুকুর পালন করেন জানতে পেরে এখানে এসেছি। বন্ধু প্রণব সাধুর একটি কুকুর লাগবে। সে কারণে আমভিটা এলাকার এই খামারে এসেছি। দুটি কুকুর নেওয়ার ইচ্ছা রয়েছে। কুকুর দেখেছি, ভালো লেগেছে। চোর-ডাকাতের উৎপাত বেড়েছে। বিদেশি কুকুর নিরাপত্তার জন্য খুব কার্যকরি। বাচ্চা কুকুর পোষ মানে, যে কারণে বাচ্চা কুকুরে নিয়ে পোষ মানাব।
প্রণব সাধু ঢাকা পোস্টকে বলেন, কুকুর কেনার উদ্দেশ্য এই খামারে এসেছি। কুকুর কিনব, যাতে বাসায় চোর না আসে। এখানে অনেক কুকুর দেখে খুব ভালো লাগল। কুকুর দেখে প্রথমে ভয় পাচ্ছিলাম, এখন স্বাভাবিক। বিদেশি কুকুর পালনের শখ রয়েছে। এতে বাড়ির নিরাপত্তাব্যবস্থাও ভালো থাকবে।