সিএনএম প্রতিনিধিঃ
সম্প্রতি ভারতে বাংলাদেশি এক তরুণীকে যৌন নির্যাতনের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ওই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্রের তথ্য পাওয়া যায়। এই চক্রের অন্যতম মূলহোতা ঝিনাইদহের আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফিসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
ঝিনাইদহ ও যশোরের অভয়নগর ও বেনাপোল এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। অন্য তিনজন হলেন, যশোরের সাহিদা বেগম ওরফে ম্যাডাম সাহিদা, ইসমাইল সরদার ও আবদুর রহমান শেখ।
র্যাব দাবি করছে, আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফি (৩০) গেল আট বছরে ৫০০ নারীকে ভারতে পতিতাবৃত্তির কাজে পাচার করা হয়। মানবপাচারকারী এ চক্রের সঙ্গে প্রায় ৫০ জন জড়িত।
মঙ্গলবার (১ জুন) সন্ধ্যায় র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সংস্থাটির লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, ভারতে নারী পাচার চক্রের মূল হোতা আশরাফুল ইসলাম আট বছর ধরে ভারতে যাওয়া আসা করতেন। জিজ্ঞাসাবাদে আশরাফুল ইসলাম স্বীকার করেন, তিনি গত পাঁচ বছরে পাঁচ শতাধিক নারীকে বিভিন্নভাবে ভারতে পাচার করেছেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা এ ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। প্রতারণার ফাঁদ পেতে তরুণীদের পাশের দেশ ভারতে পাচার করত এই চক্র। দেশি-বিদেশি ৫০ জন সংঘবদ্ধভাবে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত।
গ্রেপ্তার বস রাফির শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে প্রথমে তিনি ট্যাক্সি ড্রাইভার ও পরে হোটেলে রিসোর্ট কর্মচারী ও কাপড়ের ব্যবসা করতেন।
গত দুই বছর আগে টিকটকের হৃদয়ের সঙ্গে বস রাফির পরিচয় হয়। এরপর টিকটক হৃদয়ের মাধ্যমে প্রায় অর্ধশতাধিক তরুণীকে ভারতে পাচার করেন তিনি।
খন্দকার আল মঈন জানান, বস রাফির সহযোগী টিকটক হৃদয় বাবু অনলাইনে সোশ্যাল মিডিয়ায় তরুণীদের মাধ্যমে একটি গ্রুপ তৈরি করেন। তরুণীদের মডেল বানানোর প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে তাঁদের বিভিন্ন সুপার মার্কেট ও পাশের দেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে আশরাফুলের সহযোগিতায় বিদেশে পাচার করত ওই গ্রুপ।
নারী পাচার চক্রের মূল বিষয় তুলে ধরে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ওই ভুক্তভোগী তরুণীর বাবা ২৭ মে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার আইন ও পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা করেন। ওই মামলায় টিকটিক হৃদয়সহ অজ্ঞাতনামা আরও চারজনকে আসামি করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে র্যাব।
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তারের জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, ভিকটিমদের বৈধ বা অবৈধ উভয় পথেই সীমান্ত অতিক্রম করানো হতো। তারা প্রথমত ভিকটিমদের দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সীমান্তবর্তী জেলা- যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ নিয়ে আসতেন। এরপর ভিকটিমদের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন সেফ হাউজে নিয়ে অবস্থান করানো হতো। সেখান থেকে সুবিধাজনক সময়ে লাইনম্যানের মাধ্যমে অরক্ষিত এলাকা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করান হতো। এরপর ভারতের এজেন্টরা তাদেরকে গ্রহণ করতো।
খন্দকার আল মঈন জানান আরও জানান, সুবিধাজনক সময়ে কলকাতার সেফ হাউজে নারীদের পাঠানো হতো। পরের ধাপে কলকাতা থেকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের বেঙ্গালুরু পাঠানো হতো। বেঙ্গালুরু পৌঁছানোর পর গ্রেপ্তার বস রাফি তাদের গ্রহণ করে বিভিন্ন সেফ হাউজে অবস্থান করাত। পরে ব্ল্যাকমেইল ও মাদকাসক্তে অভ্যস্থকরণ এবং নির্যাতনের মাধ্যমে পতিতাবৃত্তি পেশায় বাধ্য করা হতো। সেফ হাউজগুলো থেকে তরুনীদের কাছে ১০ থেকে ১৫ দিনের জন্য বিভিন্ন খদ্দেরদের সরবরাহ করা হতো। ভারতের এজেন্ট তাদের প্রত্যেক খদ্দের প্রতি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা কমিশন দিত।
গ্রেপ্তার বস রাফি জিজ্ঞাসাবাদে জানান, ভারতে নির্যাতিত ওই তরুণী দুই বাংলাদেশি নারীকে দেশে পালিয়ে আসতে সহযোগিতা করেন। এজন্য তাকে অত্যাচার করা হয়। তাকেও বলা হয়, যদি তিনি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে ভিডিও স্বজনদের কাছে পাঠানো হবে।
গ্রেপ্তার বস রাফির অন্যতম নারী সহযোগী সাহিদার তত্ত্বাবধানে যশোরের সীমান্ত এলাকায় একটি সেইফ হাউজ রয়েছে। এসব সেফ হাউজে বিভিন্ন অবৈধ কার্যক্রম করা হয়। সাহিদার সোনিয়া ও তানিয়া নামে দুই মেয়ে রয়েছে। তারা পাচারের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত বলে জানায় র্যাব। সোনিয়া ও তানিয়া বর্তমানে বেঙ্গালুরে অবস্থান করছে বলে জানিয়েছে গ্রেপ্তার সাহিদা।