সিএনএম প্রতিনিধিঃ
নিষিদ্ধ স্ট্রিমকারে জুয়া খেলে বছরে পাচার হচ্ছে হাজার কোটি টাকা। নোয়াখালীর সুধারামপুর, ঢাকার সাভার এবং রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় অভিযান চালিয়ে সাইবার স্পেস ব্যবহার করে মুদ্রা পাচার চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- কুমিল্লার জমির উদ্দিন (৩৫), নোয়াখালীর হোসেন রুবেল (৩৯) ও মনজুরুল ইসলাম হৃদয় (২৬) এবং নাটোরের অনামিকা সরকার (২৪)।
এটিইউ জানায়, গ্রেপ্তারকৃরা স্ট্রিমকার নামক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে মুদ্রা পাচার করে আসছিলেন। স্ট্রিমকার অ্যাপসে গ্রুপ চ্যাট, লিপসিং, ড্যান্স, গল্প, কবিতা আবৃত্তিসহ বিভিন্ন ধরনের অনলাইন জুয়া খেলার অপশন রয়েছে। বাংলাদেশে এই অ্যাপসটিসহ যেকোনো জুয়া, অনলাইন প্রতারণা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। তবে ভিপিএনের (ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) মাধ্যমে জুয়ার অ্যাপসটি ঠিকই ব্যবহৃত হচ্ছে। অ্যাপসটি দেশে ব্যবহার-প্রসারে হাতেগোনা কয়েকজন জড়িত থাকলেও না জেনে বুঝে ব্যবহার করছেন লক্ষাধিক বাংলাদেশি। এতে জুয়া খেলতে প্রয়োজন ডিজিটাল কারেন্সি বিন্স ও জেমস। এগুলো কেনার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতি মাসে পাচার হচ্ছে শত কোটি টাকা। বছরে যা হাজার কোটিরও বেশি।
বুধবার (১৯ মে) দুপুরে রাজধানীর বারিধারায় এটিইউ’র মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস) মোহাম্মদ আসলাম খান বলেন, এটিইউ দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে এসব প্রতারণা ও ডিজিটাল মুদ্রা পাচার রোধে গোয়েন্দা নজরদারি ও তদন্ত কার্যক্রম চালাচ্ছিলো। যার অংশ হিসেবে স্ট্রিমকারের মাধ্যমে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা ও ডিজিটাল মাধ্যমে মুদ্রা পাচার কররা চক্রের চার মাস্টারমাইন্ডকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই চার সদস্য ও তাদের পাঁচ সহযোগীর বিরুদ্ধে সাভার থানায় ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।
তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগের এই অ্যাপটিতে দুই ধরনের আইডি রয়েছে। একটি হচ্ছে ইউজার আইডি, অপরটি হোস্ট আইডি। ইউজাররা সাধারণত সুন্দরীদের ও সেলিব্রেটিদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্য এই অ্যাপটি ব্যবহার করে হোস্টদের একটি হোস্ট এজেন্সির মাধ্যমে এই অ্যাপে হোস্টিং করেন। সুন্দরী এবং সেলিব্রেটিরাই সাধারণত এই এজেন্সির মাধ্যমে হোস্ট আইডি খোলেন। এতে বিন্স ও হোস্ট নামক দুই ধরনের এজেন্সি রয়েছে। বিন্স এজেন্সিগুলো বিদেশি এই অ্যাপটির অ্যাডমিনদের কাছ থেকে বিন্স ক্রয় করে ইউজারদের কাছে বিক্রি করে। এই অ্যাপের ইউজাররা এই বিন্স ও হোস্টদের সঙ্গে লাইভ স্ট্রিমিংয়ে আড্ডা দেওয়ার জন্য গিফট হিসাবে দেয়। বিন্স এক ধরনের ডিজিটাল কারেন্সি।
প্রতি এক লাখ বিন্সের মূল্য এক হাজার আশি টাকা এবং প্রতি এক লাখ জেমসের মূল্য ৬০০ টাকা বা তার কম। কিন্তু এক বিন্স সমান এক জেমস। ইউজাররা হোস্টদেরকে গিফট হিসেবে বিন্স দেন, কিন্তু এই বিন্স হোস্টদের কাছে এলেই তা জেমসে পরিণত হয়। সঞ্চিত জেমসের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে হোস্টদের আয়। তবে হোস্টদেরকে মাস শেষে বেতন পাওয়ার জন্য শুধু সঞ্চিত জেমস যথেষ্ঠ নয়। তাকে প্রতি দিন এবং প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য লাইভ স্ট্রিমিংয়ে থাকতে হয়।
এসপি আসলাম বলেন, এই বিন্স এবং জেমস নামক ডিজিটাল কারেন্সিই আমেরিকান এই অ্যাপস স্ট্রিমকারের একমাত্র চালিকা শক্তি। দেশিয় বিন্স এজেন্সিগুলো সাব-এজেন্সি নিয়োগসহ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দরীদের বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে লোভনীয় অফার দিয়ে লাইভ স্ট্রিমিংয়ে এনে ইউজারদের সঙ্গে প্রতারণাও করে থাকে।
এটিইউ’র সাইবার অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের পুলিশ সুপার মো. মাহিদুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে এই অ্যাপসের ১১ জন এজেন্ট রয়েছে। তারাই ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল কারেন্সি ক্রয়-বিক্রয় করেন। লক্ষাধিক বাংলাদেশি ইউজার বিকাশ, রকেট, নগদসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে, হুন্ডি, হাওয়ালা (ঐধধিষধ), ক্রিপ্টো কারেন্সি এবং বিদেশি একটি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল কারেন্সি ক্রয় করছেন। যার মাধ্যমে প্রতি মাসে শত কোটির বেশি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে।
এই লক্ষাধিক স্ট্রিমকার ইউজারের অনেকেই জানেন না এটা জুয়া, এটা খেলা বা বিন্স বা জেমস নামক ডিজিটাল কারেন্সি ক্রয়ে দেশিয় টাকা লেনদেন যে মুদ্রা পাচার কিংবা মানি লণ্ডারিংয়ের মতো অপরাধ। অধিকাংশ ইউজারই না বুঝে খেলছেন ও মুদ্রা পাচার করছেন।
এটিইউ সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার অনামিকা পড়াশোনা করেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে। সেখানে থাকতেই এই স্ট্রিমকার জুয়া খেলার অন্যতম প্রধান রোকন উদ্দিন সিদ্দিকীর সঙ্গে পরিচয়। এরপর তারা নিজেরা পরিবারের অজান্তে বিয়ে করেন। রাজধানীর বনশ্রীর একটি বাসা ভাড়া নিয়ে তারা স্ট্রিমকার খেলা পরিচালনা করছিলেন। গত দেড় বছরে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। অনামিকাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলেও অভিযানকালে তার স্বামী রোকন পালিয়ে যান।