সিএনএম – ঈশ্বরদী (পাবনা);
ঈশ্বরদী উপজেলার সলিমপুর ইউনিয়নের ভাড়ইমারী গ্রামের আনন্দবাজারের আশেপাশে গড়ে উঠেছে এধরণের ৬টি আবাসিক বোর্ডিং। শুয়ে ঘুমানোর জন্য কোনো চৌকি বা খাট নেই। মেঝেতে খেজুরের পাটি বা প্লাস্টিকের বস্তার উপর নিজের কাঁথা-বালিশে শান্তিতে ঘুমান দিনমজুররা । অনেকদিন ধরে যারা আছেন তাদের নিজস্ব ট্রাঙ্ক রয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, কাজ থেকে ফিরে বেশ কয়েকজন রান্নায় ব্যস্ত। একত্র হয়ে ৫-৭ জন রান্না করেন। বোর্ডিংয়ে মোট ১০টি ঘর রয়েছে। ২৫০ থেকে ৩০০ জন দিনমজুর এখানে থাকতে পারেন।
ঈশ্বরদীতে মাত্র ১৫ টাকা ভাড়ায় জমজমাটভাবে চলছে গরিবের আবাসিক হোটেল। টিনশেড এই হোটেলের সাইজ ২২ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪ ফুট প্রস্থ। পেশায় দিনমজুর প্রায় ৫০ জন মানুষ ঘরের মেঝেতে শুয়ে রাত্রিযাপন করেন। ক্ষেত-খামারে সারাদিন হাড় ভাঙ্গা খাটুনির পর রাতে এ ঘরে ঘুমান। প্রতি রাতের জন্য ভাড়া ১৫ টাকা।
স্থানীয়দের কাছে ‘লেবার বোর্ডিং’ নামে পরিচিত। আবার কেউ কেউ বলেন ‘গরিবের আবাসিক হোটেল’।
গ্রামবাসীরা জানান, সলিমপুর ইউনিয়নের ভাড়ইমারী, বক্তারপুর ও নওদাপাড়া গ্রামে সারা বছরই সবজির আবাদ হয়। পাশাপাশি ধান, পাট, সরিষা, মাশকালাই, মশুর, পেঁপে, পেয়ারাসহ বিভিন্ন ফল-ফসলের আবাদ হয়। ক্ষেত-খামারের কাজে দিনমজুরের চাহিদা থাকায় স্থানীয় দিনমজুরদের পাশাপাশি অন্যান্য জেলা-উপজেলা থেকে এখানে এসে বছর জুড়েই কাজের সুযোগ পান। রাজশাহী, নাটোর, রংপুর, কুড়গ্রাম, গাইবান্ধা, কুষ্টিয়া ও সিরাজগঞ্জ জেলার দিনমজুররা আগে স্কুলের বারান্দা ও দোকানপাটের সামনে রাত্রিযাপন করতেন। আবার পলিথিনের ছাউনি তুলে ক্ষেত-খামারেই থাকতেন।
স্থানীয় বাসিন্দা আতিয়ার রহমান এ দূরাবস্থা দেখে ভাড়ইমারি আনন্দ বাজারে দিনমজুরদের জন্য একটি ঘর নির্মাণ করে দেন। দিনমজুররা সারাদিন পরিশ্রমের পর এই ঘরে রাত্রিযাপনের সুযোগ পান। প্রথম দিকে রাত্রী যাপনের জন্য দিনমজুরদের কাছ থেকে ১০ টাকা করে নেওয়া হতো। এভাবেই প্রায় এক যুগ আগে দিনমজুরদের থাকার জন্য আনন্দবাজারে এভাবেই গড়ে ওঠে দিনমজুরদের বোর্ডিং। পরবর্তীতে চাহিদা অনুযায়ী একে একে গড়ে ওঠে ছয়টি বোর্ডিং।
পার্শ্ববর্তী নাটোরের লালপুরের মহরকয়া গ্রামের বাসিন্দা বলেন, ভাড়ইমারীতে দিনমজুরের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পাট থেকে আঁশ ছাড়ানোর কাজ করে ৭৫০ টাকা হাজিরা পাই। বোর্ডিংয়ে থাকা ও খাওয়া দিয়ে ১০০ টাকা খরচ পড়ে। বাড়ির দূরত্ব ২০ কিলোমিটার হবে। আগে সাইকেল চালিয়ে এসে কাজ করলেও এখন আর সম্ভব না। সকলে একসঙ্গে ভালোই আছি। কোনো অসুবিধা নেই। মাত্র ১৫ টাকা ভাড়া দেশের আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না।
বগুড়ার নন্দীগ্রামের বাসিন্দা বলেন, দেশের বিভিন্ন এলাকায় কাজ করেছি। এতে কম খরচে কোথাও থাকার ব্যবস্থা নেই। দিনমজুরদের থাকা ও খাওয়ার এমন সুব্যবস্থা না থাকলে এখানে এসে কাজ করা সম্ভব হতো না। শুধু থাকাই নয়, বিনোদনের জন্য রয়েছে টেলিভিশন। অবসর সময়ে টিভি দেখে সময় কাটানো যায়।
বোর্ডিংয়ের মালিক আতিয়ার রহমান জানান, দিনমজুরদের থাকার কষ্ট দেখে প্রথমে একটি ঘরের ব্যবস্থা করেছিলাম। এরপর অনেকেই বোর্ডিং খুলেছে। গরিব দিনমজুরদের উপকার হয়। ব্যবসার কোনো উদ্দেশ্য নেই।
আরেক বোর্ডিংয়ের মালিক জাহিদুর ইসলাম জাহিদ বলেন, আমার বোডিংয়ে তিনটি ঘরে ১০০ জন থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। ফসল লাগানো ও উঠানো মৌসুমে বোর্ডিংয়ে লোকজন ভরপুর থাকে। তখন প্রতিদিন ১,৫০০ টাকা আয় হয়। এটি আমরা সেবামূলক কাজ হলেও যথেষ্ট আয়ও হয়।
সলিমপুরের চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বাবলু মালিথা জানান, সলিমপুর ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামেই বছরজুড়ে সবজির আবাদ হয়। প্রতিদিন তিন থেকে চার হাজার দিনমজুর আশপাশের উপজেলা ও জেলা থেকে এসে কাজ করে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা এসব দিনমজুরদের অনেকেই কাজ শেষে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন না। গরিব দিনমজুরদের থাকার জন্য মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্থানীয়রা লেবার বোর্ডিং করে দিয়েছেন। এখানে দিনমজুররা খুব কম ব্যয়ে স্বাচ্ছন্ধে থেকে কাজকর্ম করতে পারে। দিনমজুরদের আবাসন সুবিধা হওয়ায় স্থানীয় কৃষক ও দিনমজুর দু’পক্ষেরই উপকার হয়েছে।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মাসুদ রানা জানান, দিনমজুরদের থাকার জন্য লেবার বোর্ডিং বা আবাসিক কোনো ব্যবস্থা রয়েছে এটি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে এ বিষয়টি দেখবো।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার জানান, ঈশ্বরদীতে কৃষি কাজ করতে প্রতিদিন হাজার হাজার দিনমজুর পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে আসে। এদের থাকার জন্য আবাসিক কোনো ব্যবস্থা রয়েছে, এটি আমার জানা নেই। মাঝে মধ্যেই ভাড়ইমারী আনন্দবাজারে যাই। এবার গেলে দিনমজুরদের বোর্ডিংগুলোর খোঁজখবর নেবো।