দিনটি ছিল শুক্রবার (২২ এপ্রিল)। ২০ রমজান। ইফতারের আগে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ব্যাগ ভর্তি টাকা পান লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশের শিক্ষানবিশ উপ-পরিদর্শক (টিএসআই) মো. শাহ আবদুল্লাহ আল মারুফ। টাকা পাওয়ার পর ঘটনাস্থলেই ৪৫ মিনিট অপেক্ষা করেন। পরে পোশাক ব্যবসায়ীকে তার টাকা ফেরত দেন। এ ঘটনায় প্রশংসায় ভাসছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
ব্যাগে থাকা ৩ লাখ ২৮ হাজার টাকা ফেরত পেয়ে খুশি ব্যবসায়ী মো. এরশাদ হোসেন। তিনি রাজধানীর ইসলামপুরের রয়েল টাওয়ারের রুপসী বাংলার স্বত্বাধিকারী। তিনি ফরিদপুর জেলা সদরের মুরারীদহ এলাকার মো. ইসমাইল শেখের ছেলে। টাকা পাওয়ার বিষয়ে রোববার (০৮ মে) রাতে মুঠোফোনে জানতে চাইলে পুলিশ কর্মকর্তা মারুফকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন ব্যবসায়ী।
পুলিশ কর্মকর্তা মারুফ ও ব্যবসায়ী মো. এরশাদ হোসেন জানান, ২০ রোজার দিন সব কাজ শেষে মারুফ পুলিশ লাইন্স থেকে রামগঞ্জ যাওয়ার উদ্দেশে শহরের উত্তর তেমুহনী সিএনজি স্টেশনে আসেন। এদিকে শহরের চকবাজারের কয়েকটি দোকান থেকে বকেয়া টাকা নিয়ে এরশাদও একই স্থানে আসেন। উত্তর স্টেশন থেকে সিএনজিযোগে রামগঞ্জ যেতে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। মারুফ ব্যবসায়ীর সঙ্গে ভাগাভাগি করে ভাড়া দিয়ে সিএনজিটি রিজার্ভ নিতে চেয়েছিলেন। সিএনজি ভাড়া ছিল ২৫০ টাকা। এতে একজনের ভাগে পড়ে ১২৫ টাকা। কিন্তু ব্যবসায়ী কোনোভাবেই ১০০ টাকার বেশি দিতে রাজি হননি। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়।
অন্যদিকে ইফতারের সময়ও ঘনিয়ে আসছিল। এতে বাড়তি টাকার কথা চিন্তা না করে মারুফ ব্যবসায়ীর সঙ্গে একই সিএনজিতে রওনা দেন। ইফতারের আগ মুহূর্তে রামগঞ্জ পৌর শহরের ট্রাফিক বক্স এলাকায় গিয়ে ব্যাগটা রেখেই এরশাদ সিএনজি থেকে নেমে যান। ব্যাগটা দেখে সন্দেহ হওয়ায় মারুফ নিজের কাছে ব্যাগটি রাখেন। তবে সিএনজি চালক অন্য কারও ব্যাগ বলে দাবি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চালকের কথা সন্দেহজনক ছিল।
ইফতারের সময় হয়ে যাওয়ায় ট্রাফিক বক্সের পাশে এক বন্ধুর দোকানে মারুফ ইফতার করেন। তার ধারণা ছিল, নিশ্চয়ই ব্যাগটি খুঁজতে ব্যবসায়ী আসবেন। প্রায় ৪৫ মিনিট পর ব্যবসায়ী আসেন। তাকে দেখতে পেয়েই ছুটে যান ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তাসহ মারুফ। সবার সামনে ব্যাগটি ব্যবসায়ী ফিরিয়ে দেন তিনি।
ব্যবসায়ী মো. এরাশাদ হোসেন বলেন, মারুফ স্যার খুব সৎ লোক। টাকার ব্যাগ পেয়ে আমার জন্য প্রায় ৪৫ মিনিট অপেক্ষা করেছেন। আমি সিএনজি স্টেশনে টাকা খুঁজতে আসতেই দূর থেকে দেখে কাছে এসে টাকার ব্যাগ ফিরিয়ে দিয়েছেন। ব্যাগে কি ছিল হয়তো মারুফ স্যার জানতেন না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি তাকে মনে রাখব। তাকে কখনই ভুলব না।
তিনি আরও বলেন, পুলিশ জনগণের বন্ধু, মারুফ স্যার তা প্রমাণ করে দিয়েছেন। মানুষ পুলিশকে নিয়ে অনেক কথা বলে। মারুফ স্যারের সততায় পুলিশের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস বেড়ে গেছে। মানুষ হিসেবে মারুফ স্যার খুব সৎ।
জানা গেছে, মো. শাহ আবদুল্লাহ আল মারুফ উপ-পরিদর্শকের ৩৮তম ব্যাচে লক্ষ্মীপুর জেলা পুলিশ লাইন্সে শিক্ষানবিশ হিসেবে দায়িত্বরত রয়েছেন। তিনি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার ৪ নং গুপ্টি ইউনিয়নের ঘনিয়া গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা মোহাম্মদ মহিব উল্যা লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক। বাবার চাকরির কারণে রামগঞ্জ উপজেলা শহরে তার ২৫ বছর কেটেছে। বন্ধুরাও সব রামগঞ্জের। মারুফ নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।
মো. শাহ আবদুল্লাহ আল মারুফ বলেন, আমাদের কর্মস্থল এলাকার বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই। রামগঞ্জ জেলার ভেতরে হওয়ায় বন্ধুদের সঙ্গে ইফতার করার লোভ সামলাতে পারিনি। তাই ছুটে গেলাম। সিএনজিতে পড়ে থাকা ব্যাগটি ব্যবসায়ীরই হবে ধারণা ছিল। সিএনজি থেকে নামার পর তাকে আশপাশে দেখা যায়নি। প্রায় ৪৫ মিনিট পর তিনি সিএনজি থেকে যেখানে নেমেছেন, সেখানে আসেন। আমিও ধারণা করেছিলাম, তিনি আসবেন। এজন্য আমি অপেক্ষায় ছিলাম। পরে তাকে ব্যাগটা ফিরিয়ে দেই।
তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীকে কোথাও না দেখে, ভিজিটিং কার্ড আছে কিনা খোঁজার জন্য ব্যাগটি খুলে টাকা দেখতে পাই। টাকাগুলো ফেরত দেওয়া আমার দায়িত্ব ছিল। এজন্য দীর্ঘক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করেছি। টাকাগুলো ফেরত দিয়ে দায়িত্ব পালন করেছি। যদি তাকে না পেতাম তাহলে জেলা বা থানা পুলিশ হেফাজতে টাকাগুলো জমা করতাম। আর টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়টি আমি প্রকাশ করতে চাইনি। এজন্যই ব্যবসায়ীকে টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার পরও কাউকে কিছু জানাইনি। সম্প্রতি ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশে কর্মরত বাদশা নামে আমার এক বন্ধুকে বিষয়টি জানাই। সে ঘটনাটি ৭ মে তার নিজ ফেসবুক আইডিতে প্রকাশ করেন।