ঢাকা শহরে নানা ঐতিহাসিক স্মৃতি মনে করাতে রয়েছে বিভিন্ন পুরোনো স্মৃতি এছাড়া নানা দর্শনীয় স্থান ও জিনিস বা পণ্য। ঢাকা যাদুঘরে গেলে চোখে পড়ে নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন। এর বাইরেও অনেক স্থানে চোখে পড়ে ছোট—বড় অনেক ধরনের ঐতিহাসিক নিদর্শন। এর মধ্যে রাজধানীর ওসমানি উদ্যোনে দক্ষিণ পশ্চিমে কোর্ণারে গেইট দিয়ে প্রবেশ করলে বা বাহির থেকে গেইটের ভিতর ওসমানি উদ্যোনে যে কারো চোখ পড়লেই দেখা মিলে সেই পুরানো এক স্মৃতি যার একটি হলো কামান। এ কামানকে বলা হয় ঢাকার কামান। এর রয়েছে শক্তিশালী ইতিহাস। ঢাকার কামান দেখলে সহজেই মনে হয়, যুদ্ধের মতো রক্তক্ষয়ী বিষয়ে তা ব্যবহৃত হয়েছে। এর নির্মাণশৈলী যেমন উন্নত, তেমনি এর আকার বিশাল। এটিকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরাতে ভারি যন্ত্রের প্রয়োজন। আর এসব জিনিসই ঢাকাবাসীর গর্ব।
ঢাকার যে দু’টি কামানের ইতিহাস আছে তাদের দু’টি নামও আছে। নাম দু’টো কালে খাঁ জমজম ও ‘বিবি মরিয়ম’। কামান দু’টির নাম কে দিয়েছেন তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় এই কামানের নাম দেওয়া হয় কালে খাঁ নামে কোনো বীর বা শহীদের নামানুসারেই। আর বিবি মরিয়ম হতে পারে কালে খাঁর পরিবার বা স্ত্রীর নাম। সবচেয়ে বড় ছিল কালে খাঁ জমজম কামানটি। আর তার চেয়ে আকারে ছোট বিবি মরিয়ম।
ভারতবর্ষের সর্ববৃহৎ কামানের যে তালিকা প্রস্তুত করেন সম্রাট আওরঙ্গজেব, তার অন্তর্ভুক্ত ছিল কালে জমজম খাঁ। অনেকেই এ বিষয়ে অনেক কিছুই লিখেছেন। বিখ্যাত ভূগোলবিদ রেনেল তাঁর স্মৃতিকথায় কালে খাঁ জমজমের বিষয়ে লিখেছেন। বিবি মরিয়মের দৈর্ঘ্য ১১ ফুট প্রায়। এর মুখের ব্যাস প্রায় ছয় ইঞ্চি। আর পাঁচ মণ বলা হয় এর গোলার ওজন। মীর জুমলাকে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবেদার করে পাঠান সম্রাট আওরঙ্গজেব। মীর জুমলা আসাম অভিযানকালে বেশ কয়েকটি ভারী কামান ব্যবহার করেন ১৯৬১ সালে। আর এগুলোর মধ্যে সবার চেয়ে বড় হলো বিবি মরিয়ম। এতেই বুঝা যায় কালে খাঁ জমজম কামানটি কত বড় ছিল। তিনি যুদ্ধে জয়লাভ করে ফিরে এসে বিবি মরিয়মকে স্থাপন করেন বড় কাটারার দক্ষিণ দিকে সোয়ারী ঘাটের পাশে। আর তখন থেকে এটি পরিচয় লাভ করে মীর জুমলার কামান হিসেবে। তখনো কালে খাঁ জমজম রাখা ছিল মোগলাই চরে। সেটি ইংরেজ আমল। ওই সময় সেখানে দেখা দেয় ভাঙন। ভাঙন ছিল চারদিক দিয়েই। ফলে কামানটি ছিল হুমকির মুখে। আর এটির ব্যাপারে বেশ উদাসীনও ছিলেন কর্তৃপক্ষ। যে কারণে কালে খাঁ জমজম একদিন তলিয়ে যায় বুড়িগঙ্গায়
বিবি মরিয়মকে সোয়ারী ঘাট থেকে সরিয়ে নেয়া হয় পুরান ঢাকার চকবাজারে। এ কাজটি করেন ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ওয়ালটারস ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে। তবে চকবাজার ক্রমে পরিণত হয় ঘিঞ্জি বা ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে। তাই কামানটি সেখান থেকে স্থানান্তর করা হয় সদরঘাটে। এ কাজটি করেন ঢাকা যাদুঘরের কিউরেটর নলিনী কান্ত ভট্টশালী ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে। অতঃপর বিবি মরিয়মকে গুলিস্তান বর্তমান মোড়স্থ পাতাল মার্কেটের পূর্ব সাইডে স্থাপন করা হয় গত শতকের পঞ্চাশের দশকে। ওই সময়ও বেশ জমজমাট থাকতো গুলিস্তান। অনেকে রসিকতা করে গুলিস্তানকে বলতেন ঢাকার রাজধানী। ওই সময় থেকে মানুষ গুলিস্তানের কামান বলতো এটিকে দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের দুরদান্তো থেকে মানুষজন দেখার জন্য ঢাকায় ছুটে আসতো, এটি দেখেই মুগদ্ধ হয়ে যেত অনেকেই গ্রাম—গঞ্জের হাট—বাজার আর চায়ের দোকান, ফার্মেসিগুলোতে এবং বাড়ি বাড়ি নারী—শিশু পুরুষদের মুখে মুখে এ কামনের গল্প শুনা যেত। এরপর এই কামানটি স্থাপন করা হয় ঢাকার ওসমানী উদ্যোনের দক্ষিণ—পশ্চিম গেইট দিয়ে প্রবেশদ্বারে ১৯৮৩ সাল হতে এখন পর্যন্ত সেখানেই বিদ্যমান বিবি মরিয়ম। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সে কামানের আগের মতো আর কদর নেই। নানাবিধ অবহিলতভাবে পড়ে আছে। কামানটিকে ব্যবহার করা হয় আশে—পাশের ভাসমানদের প্রয়োজনীয় ব্যবহারে।