প্রমত্ত পদ্মা কেবল বিশালই নয়, ভয়ংকরও। দেশের মধ্যভাগ ও পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে ছিল এই পদ্মা। খরস্রোতা সেই পদ্মার ওপর সেতু নির্মাণের মধ্যে দিয়ে দূর হলো সেই বাধা, আর সেতুর উদ্বোধনের মধ্যে দিয়ে খুলে গেল দখিনা দুয়ার।
আজ শনিবার এই সেতুর উদ্বোধন ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামীকাল থেকে সেতুতে শুরু হবে যান চলাচল।
পদ্মা সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরুর মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন দিগন্তের দ্বার উম্মোচন হবে। ২১ জেলার মানুষের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বহুমুখি অর্থনৈতিক দ্বার উন্মোচন হবে বলেও আশা করা হচ্ছে।
পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা থেকে বরিশাল যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩ ঘণ্টা, আর কুয়াকাটা যেতে সময় লাগবে মাত্র ৫ ঘণ্টা। ফলে বদলে যাবে পদ্মার দক্ষিণ পাড়ে থাকা জেলাগুলোর মানুষের ভাগ্য। জেলায় উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনেও বড় ভূমিকা থাকবে পদ্মা সেতুর।
জীবন যাত্রার মান ও ভাগ্যের পরিবর্তন আসবে নড়াইলের মানুষেরও। রাজধানীর সঙ্গে এ জেলার যোগাযোগে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন। নড়াইলের ওপর দিয়ে যাবে এশিয়ান হাইওয়ে সড়কটি, যেটা মিশবে বেনাপোল স্থল বন্দরে। ফলে নড়াইলসহ ঢাকার সাথে আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে।
এই সেতু যোগাযোগের মেলবন্ধনই তৈরি করছে না, উন্মুক্ত করে দিচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবাধ সম্ভাবনাকে। এই সেতু ঘিরে শরীয়তপুরের আবাসন খাতে ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। এ জেলায় তৈরি হচ্ছে নতুন-নতুন শপিংমল, মার্কেট ও স্বতন্ত্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আর এ মহাযজ্ঞের হাত ধরে ব্যাপক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে জীবন-মানেরও ব্যাপক উন্নয়নের স্বপ্ন বুনছে জেলার ব্যবসায়ীরা।
যুগের পর যুগ ধরে এই একটি সেতুর অভাবে সীমাহীন দুর্ভোগ সহ্য করেছেন কোটি কোটি মানুষ। সেতু ঘিরে ব্যাপক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে পিরোজপুরের মানুষ। উচ্চ শিক্ষা, কর্মসংস্থান, পর্যটন, পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে এ জেলার জন্য আমূল পরিবর্তন আসবে।
ঝালকাঠি জেলার সর্বস্তরের মানুষও নতুন-নতুন স্বপ্নের জাল বোনা শুরু করেছে। জেলা সদর থেকে লঞ্চ বা বাসযোগে ঢাকা পৌছাতে সময় লাগতো ১২ থেকে ষোল ঘন্টা। আবার কখনও ফেরীঘাটে যানজটের কারনে সময় লেগে যায় ১৮ থেকে ২০ ঘন্টা। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হলে মাত্র পাঁচ মিনিটে বাসযোগে সেতু পাড়ি দিয়ে সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টায় পৌঁছানো যাবে ঢাকা। এ যেন এক স্বপ্ন এ জেলার মানুষের কাছে।
পদ্মা সেতুর উৎসবে মেতেছে যশোরের মানুষও। পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সঙ্গে এই জেলাতেও ঘটবে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার।দেশের বৃহত্তর স্থলবন্দর বেনাপোল বন্দরের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পাবে, বাড়বে প্রবৃদ্ধি। ফুল চাষের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের জন্য শুভবার্তা নিয়ে এসেছে পদ্মা সেতু।
পদ্মা সেতু অবদান রাখবে চুয়াডাঙ্গার উন্নয়নেও। বদলে যাবে চুয়াডাঙ্গার ব্যবসার চিত্র। অল্প সময়ে ও খরচে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খুব সহজে যে কোন পণ্য আনা নেওয়া দ্রুত সময়ে সম্ভব হবে। সেতুর সুফল কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে এ জেলা। পদ্মা সেতু ঘিরে চুয়াডাঙ্গায় নতুন নতুন শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠবে বলেও আশা করা হচ্ছে।
বরগুনায় উন্মোচিত হবে শিল্প উদ্যোগের নতুন দ্বার। ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহরগুলোর সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ ও পরিবহন সুবিধা পাবে এ জেলা।
ফেনীর পৌর মৎস্য আড়ত থেকে বছরে ৭০০ কোটি টাকার মাছ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হলে এ খাতে বইয়ে যাবে সুবাতাস, মাছের বর্তমান সরবরাহ দ্বিগুণ হতে পারে।
পদ্মা সেতু ঘিরে পর্যটন বিকাশের নতুন স্বপ্ন দেখছে বাগেরহাট। এছাড়া কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, কর্মসংস্থান সব ক্ষেত্রেই পড়বে অগ্রগতির ছাপ। পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকা থেকে এ জেলার দূরত্ব হবে ১৭২ কিলোমিটার। এখন মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টায় ঢাকায় যেতে পারবেন বাগেরহাটবাসী।
বেনাপোল বন্দরের মতোই পদ্মা সেতু চালু হলে আরও সচল হবে মোংলা বন্দর। আমদানি-রপ্তানি বাড়বে এ বন্দরেও। পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিনিয়োগে ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করবে। পায়রা ও ভোমরা স্থলবন্দরেও আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ বাড়বে।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে উচ্ছ্বাসে ভাসছে কৃষিনির্ভর মেহেরপুর জেলার মানুষও। বহু অপেক্ষার এই সেতু মেহেরপুরে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এই অঞ্চলের মানুষের আর্থ সামাজিক ও জীবনযাত্রার মানের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাবে সেতু।
পদ্মা সেতুর কারণে খুলনায় কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন ও হযরত খানজাহান আলী (রা.) মাজার, ষাট গম্বুজ মসজিদ ঘিরে পর্যটনের ব্যাপক প্রসার ঘটবে।
পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণের জেলাগুলো থেকে ঢাকামুখি অভিবাসীদের চাপ কমবে বলেও আশা করা হচ্ছে। পদ্মা সেতুর ফলে যোগাযোগ মাধ্যমের অভূতপূর্ব যে সুবিধা সৃষ্টি হবে তার ফলে স্থানীয় পর্যায়ে নানা সুযোগ সৃষ্টি হবে।
স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে ঘিরে পরিবহন ও যোগাযোগের নতুন দুয়ার খুলবে ঝিনাইদহে। অর্থনীতিতে যুক্ত হবে বহুমুখিতা, জেলার মানুষের জীবনে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন। এছাড়া মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা মিলে গড়ে উঠবে পর্যটন জোন।
বর্তমানে যেখানে কুষ্টিয়া থেকে বছরে ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়, পদ্মা সেতু চালুর ফলে তা ৩০০ কোটিতে গিয়ে দাঁড়াবে বলে স্থানীয়ভাবে আশা করা যাচ্ছে। এছাড়া কুষ্টিয়া থেকে ঢাকা পৌঁছাতে যাত্রীদের ভোগান্তি কমবে।