অতিমারি করোনার আগে থেকে বিরোধী সব দলকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্যের কথা বলছে
বিএনপি। দলের বিভিন্ন সভা-সমাবেশ থেকে জাতীয় ঐক্য গড়তে জোর দেওয়া হয়। যার যার অবস্থান থেকে ছাড় দিয়ে সরকারবিরোধী বৃহৎ জোট গঠনের আহ্বান জানানো হয়। এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় ইতোমধ্যে কেটে গেছে দুবছর। তবু বিএনপির ঐক্য এখনও নড়বড়ে। দলটির ভাষ্য, কিছু অনৈক্য থাকলেও তা সহজে মিটমাট হয়ে যাবে। তবে বাস্তবে ঐক্য প্রক্রিয়া আরও জটিল হচ্ছে।
শরিকরা বলছেন, সবই ঠিকঠাকভাবে এগোচ্ছিল। হঠাৎই বিএনপি জাতীয় সরকারের রূপরেখা গণমাধ্যমে তুলে ধরায় ঐক্য প্রক্রিয়া বিলম্বিত করেছে। এটি তারা ভালো চোখে নেননি। এখনই জাতীয় সরকার নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন ছিল না। তাদের আন্দোলনের লক্ষ্য কেবল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়। দেশের মানুষের স্বাধীনতা, মুক্তি ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া। সেটা দিতে হলে তিন মাসের একটি সরকারের মাধ্যমে সম্ভব নয়।
বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় সরকার ইস্যুতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, নির্বাচনের পর সবাইকে নিয়ে হবে জাতীয় সরকার। এ বিষয়টি জনগণের কাছে আরও পরিষ্কার করতে হোমওয়ার্ক করছে তারা। দলের হাইকমান্ডের কাছ থেকে সুস্পষ্ট রূপরেখা আনা হয়েছে। তবে ঐক্যের শরিকরা বিষয়টি মানতে নারাজ। তারা চান নির্বাচনের আগেই জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে, যে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে সবকিছু।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, এই সরকারকে বিদায় করতে আমরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কথা বলছি; কিন্তু আমাদের মতপার্থক্য কমছে না। এ কারণে বক্তব্য যতই দিই, একমঞ্চ হবে না। তার মতে, সরকারকে বিদায় করতে হলে বর্তমান বাস্তবতায় অভিন্ন কর্মসূচিতে যুগপৎ আন্দোলন করতে হবে। সেক্ষেত্রে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মতো চার-পাঁচটি মঞ্চ হতে পারে। এ রকম জায়গায় যদি আসতে পারি, আমরা একসঙ্গে এগিয়ে যেতে পারব, আন্দোলনও সফল হবে। তিনি বলেন, আমাদের নিজেদের মধ্যে এখনও ঐক্য হয়নি, তবে ঐক্য হচ্ছে। সেটা যেন যাতে ভেঙে না যায় সেজন্য বিতর্কিত কোনো কথা, কোনো কাজ না করাই ভালো। এজন্য বিএনপিকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক জানান, বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে এখন পর্যন্ত কোনো বৈঠক করেনি। তারা জাতীয় সরকারের ফর্মুলা দেওয়ার পর নতুন করে আমাদের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। ইফতারের কথা শুনেছিলাম, তা বাতিল করা হয়েছে। আমরা বারবার বলছি, সরকার বদল করে সরকার আনার জন্য লড়াই করছি না। মৌলিক কিছু বিষয়ে একমত হওয়ার প্রয়োজন মনে করছি। দেখা যাক কী হয়।
গণফোরামের একাংশের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা মোহসীন মন্টু বলেন, সরকারকে বিদায় করতে হলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে না পারি, তা হলে জনগণ মনে করবে, আমরা আন্দোলন আন্দোলন খেলা করছি।
আর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমাদের ছোটখাটো ভুল বোঝাবুঝি, ছোটখাটো বিভেদ সব ভুলে গিয়ে মানুষের ভোটের অধিকারকে ফিরিয়ে আনার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সেজন্য আমরা সবসময় জাতীয় ঐক্যের কথা বলছি, জাতীয় ঐক্যের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করছি।
ঐক্য গড়তে অনানুষ্ঠানিকভাবে কয়েকবার সমমনা শরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আলোচনার মধ্য দিয়েই অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য সৃষ্টি হবে এবং কর্মসূচিও সমন্বিতভাবে আসবে।
এদিকে ২০-দলীয় জোট ও সমমনা রাজনীতিকদের সম্মানে আগামীকাল ২০ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় ইফতার অনুষ্ঠান বাতিল করেছে বিএনপি। কারণ হিসেবে তারা স্পষ্ট কিছু না বললেও ঐক্যের মধ্যে সৃষ্ট অনৈক্যের কারণে তা বাতিল করা হয়েছে বলা জানা গেছে। ইফতার করতে গেলে সেখানে বিতর্কিত জামায়াতে ইসলামীও শরিক হবে। আর তা হলে ঐক্যের কেউ কেউ নাখোশ হবেন। সামনাসামনিও ক্ষোভ প্রকাশের আশঙ্কা রয়েছে। জাতীয় সরকার ইস্যুতে বিতর্ক সৃষ্টির পর বেশ সতর্কে পা ফেলছে বিএনপি। কোনোভাবে এবারের ঐক্য ভেস্তে যেতে দিতে চান না তারা। বিশেষ করে ‘জাতীয় সরকার ও জামায়াত’ ইস্যুটি বৃহত্তর ঐক্যে বিতর্ক সৃষ্টি করছে।
এদিকে ‘অতি অল্প সময়ের মধ্যে’ প্রধানমন্ত্রী শক্তিশালী বিরোধী দল দেখতে পাবেন বলে সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপির মহাসচিব বলেন, পার্লামেন্টে বিরোধী দল নেই সরকারের কারণে। প্রধানমন্ত্রী কোনো ধরনের শক্তিশালী বিরোধী দল দেখতে চান, আমরা ঠিক সেটা বুঝি না। উনি যেটা দেখতে চাচ্ছেন, অতি অল্প সময়ের মধ্যে সেটা উনি দেখতে পাবেন।
সূত্র জানায়, বৃহত্তর জোট গঠনে দেরি হওয়ায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায়ে নিজেদের আন্দোলন-কর্মসূচির সম্ভাব্য পদ্ধতি ঠিক করছে বিএনপি। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে ধারাবাহিকভাবে। সময় বেশি নষ্ট হলেও তারা এবার ঐক্য গঠনে বেশ সতর্ক থাকবে। বড় ঐক্য গড়তে গিয়ে যাতে নিজেদের অভ্যন্তরীণ শক্তি-সামর্থ্য না কমে যায় সেদিকে মনোযোগ বাড়াচ্ছে দলটি।
বিএনপি আরও সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী হয়ে মাঠে নামার জোরদার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে লক্ষ্যে তারা ঢাকা মহানগর বিএনপিকে ঢেলে সাজাচ্ছে। ইউনিট থেকে থানা পর্যন্ত যোগ্য ও ত্যাগীদের নেতৃত্বে আনতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি। ইতোমধ্যে দুই সিটিতে গঠন করা হয়েছে একাধিক উপকমিটি। দুদিন আগে উত্তরের ৭১টি ও দক্ষিণের ৭০টি ওয়ার্ডে নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। ভেঙে দেওয়া হয়েছে দুই সিটির সব থানা কমিটি। কাউন্সিলের মাধ্যমে এসব কমিটি দ্রুত পুনর্গঠনে কাজ চলছে। শিগগিরই ওয়ার্ড ও থানা কমিটি গঠন শেষ করা হবে। এরপর কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে পুনর্গঠন করা হবে মহানগর বিএনপি।
দলটির সাংগঠনিক নেতারা জানান, অতীতে ঢাকা মহানগর বিএনপি আন্দোলন-সংগ্রামে শতভাগ সফলতা দেখাতে পারেনি। এবার অনেক প্রত্যাশা নিয়ে ঢাকা মহানগরে নতুন কমিটি দেওয়া হয়েছে। এরা পরীক্ষিত নেতা। আন্দোলনমুখী একটা নেতৃত্ব গড়ে তুলতে কাজ চলছে। কঠিন সময়ে রাজপথে থাকার অঙ্গীকার করে নেতা বানানো হচ্ছে।
শুধু মহানগর নয়, বিএনপির ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকেও আরও যুগোপযোগী করে তোলা হচ্ছে। রোববার ফজলুর রহমান খোকন ও ইকবাল হোসেন শ্যামলের নেতৃত্বাধীন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করে পাঁচ সদস্যের নতুন আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছাত্রদলের বিদ্যমান কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন আংশিক কমিটি দিয়েছেন। এ কমিটিতে কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণকে সভাপতি ও সাইফ মাহমুদ জুয়েলকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে।