আরমান বাদলঃ
পুরান ঢাকার বাদামতলী থেকে দেশের বৃহত্তম ফল কেনাবেচার পাইকারি আড়ত স্থানান্তর হতে পারে নতুন ঠিকানায়। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে যাত্রাবাড়ী ও মোহাম্মদপুরের বছিলা। এ দুই স্থানের যে কোনো একটিতে এ বাজারের ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনাও রয়েছে বলে জানা গেছে।
পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়িক এলাকাগুলো যখন মন্দায় আক্রান্ত, তখন বাদামতলীতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন ব্যবসায়ী। নতুন এই ব্যবসায়ীদের জায়গা দেওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে স্থানান্তরের এ সিদ্ধান্তকে বাদামতলীর ফল ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগই স্বাগত জানাচ্ছেন। কারণ, এক বছর আগেও বাদামতলীর যেখানটায় ছিল একটি টিনের ঘর, সেখানে হয়েছে চারতলা একটি ভবন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি প্রশাসক জানান, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে সিটি করপোরেশন কাজ শুরু করবে।
তবে এরই মধ্যে বাদামতলী থেকে ফলের বাজার স্থানান্তরের বিরোধিতায় নেমে পড়েছে একটি পক্ষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ফল ব্যবসায়ী বলেন, বাদামতলীতে যারা নিজেদের ভবনে ব্যবসা করছেন এবং অন্য ব্যবসায়ীদের ভাড়া দিয়েছেন, তারাই বাজার স্থানান্তরে সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করছেন। কারণ, স্থানান্তর হলে তাদের ভাড়া বাণিজ্য কমে যাবে।
জানা যায়, ঐতিহ্যবাহী আহসান মঞ্জিলের ২০ গজ পশ্চিমে ১৯৩৫ সাল থেকে চলছে বাদামতলী ফলের আড়ত। ধীরে ধীরে বাজার বিস্তৃত হয়েছে ওয়াইজঘাট পর্যন্ত। হাসান আলী ঢালীসহ চার-পাঁচজন ব্যবসায়ীর ফল কেনাবেচা দিয়ে এ বাজারের যাত্রা শুরু। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তা বেড়ে ২০ থেকে ২৫ জন ব্যবসায়ীর বাজারে পরিণত হয়। সেই বাজারে এখন দুই শতাধিক আড়তদার, চার শতাধিক পাইকার, তিন শতাধিক ফড়িয়া ও শতাধিক খুচরা ব্যবসায়ী ফল বিক্রি করেন।
বাদামতলীতে বিভিন্ন বিদেশি ফল ও ওয়াইজঘাটের পাইকারি বাজারে দেশি ফল পাওয়া যায়।
বাদামতলী ও ওয়াইজঘাটের আড়তঘর ছাড়িয়ে ফলের বাজার বসে রাস্তা থেকে নদীর তীর পর্যন্ত। ধীরে ধীরে ফল ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে বুড়িগঙ্গা তীর। তৈরি হয়েছে নদীর জায়গা দখল করে আধাপাকা ঘর। কয়েক দফায় অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দেওয়া হলেও কিছুদিন পর আবার তা দখল হয়ে যায়। দিনের পর দিন বাদামতলীর ফল আড়ত ও ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এমন হচ্ছে। এখন এখানে বাজার সম্প্রসারণের জায়গা নেই। এর ফলে একতলা ও টিনের ঘরগুলো ভেঙে বহুতল ভবন করা হয়েছে। এখন এক ভবনেই বহু আড়ত বসছে। এমনকি আশপাশের রাস্তায় ফল বিক্রির জন্য বসছেন ব্যবসায়ীরা। এতে পুরো এলাকায় যানজট লেগে থাকে। তাই এখান থেকে ফলের আড়ত সরানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
বাদামতলীর ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফারুক সিদ্দিকী বলেন বাজার স্থানান্তরের বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আরও আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হবে। তবে এ ক্ষেত্রে নতুন জায়গায় কেমন সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে, সে বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ ট্রাকে ফল ওঠানামা করছে এ বাজারে। নতুন স্থানে এত ট্রাকের পণ্য খালাস ও পণ্য তোলার ব্যবস্থা করা যাবে কি-না, তা দেখতে হবে। ফল সংরক্ষণের জন্য হিমাগার স্থাপনের সুযোগ থাকতে হবে। শহরের বাইরে ব্যবসা করার জন্য ব্যাংকি সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
বাদামতলীর ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাধন চন্দ্র দাস বলেন, পুরান ঢাকার সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য সরকার বাজার স্থানান্তরের যে পরিকল্পনা নিয়েছে, তা না মেনে উপায় থাকবে না। নতুন ঠিকানায় ফলের আড়ত স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত মেনে নিলে হয়তো ব্যবসায়ীদের লাভই হবে। তবে হুড়োহুড়ি করে ব্যবসায়ীদের ওপর যেন কিছু চাপিয়ে দেওয়া না হয়, তা-ও খেয়াল রাখতে হবে।
তিনি বলেন, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র বাদামতলী ফল আড়তের ব্যবসায়ীদের সড়ক ও নদীর তীর ছেড়ে দেওয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তারই পরিপ্রেক্ষিতে বাজার স্থানান্তরের আলোচনা এসেছে। ব্যবসায়ীরা যাত্রাবাড়ী ও মোহাম্মদপুরের বছিলায় এ বাজার স্থানান্তরের দাবি জানিয়েছেন।
ফল ব্যবসায়ীদের এ সংগঠনের দুই নেতাই স্বীকার করলেন, বাজারের পরিসর বাড়ায় বাদামতলীতে জায়গার সংকুলান হচ্ছে না। ৬০ থেকে ৭০টি ভবনে এখন আড়ত রয়েছে। আগে একতলা একটি ঘরে একজন ব্যবসায়ী ছিল। এখন আশপাশে সম্প্রসারণের সুযোগ না থাকায় বহুতল ভবন করে বাজার ওপরের দিকে উঠছে; কিন্তু সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি। সংকুচিত সড়কে ব্যবসায়ীরা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছেন। এ বাজার স্থানান্তরে সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ব্যবসায়ীরা যেতে আগ্রহী হবেন।
বাদামতলীর বেশিরভাগ ব্যবসায়ী স্থানান্তরে আগ্রহী থাকলেও কিছু ব্যবসায়ী দ্বিমতও করছেন। রুবাইয়া এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ও ফল আমদানিকারক আবদুর রহিম বলেন, বাদামতলী থেকে সড়ক ও নৌপথে সারাদেশের সঙ্গে ব্যবসা করার সুযোগ রয়েছে। অন্য কোথাও একসঙ্গে পণ্য পরিবহনে দুই ধরনের সুযোগ পাওয়া কঠিন হবে।
পাইকারি ফল ব্যবসায়ী আনিস মিয়া অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, নতুন জায়গায় বাজার স্থানান্তর করলে পরিকল্পিত বাজার গড়ে উঠবে। এতে বাজার আরও জমজমাট হবে। এখন যানজটের কারণে অনেক ক্রেতা বাদামতলীতে আসতে চান না। খোলামেলা পরিবেশে নতুন বাজার হলে ক্রেতাদের ভিড় বাড়বে।
জানা যায়, ১৯৭১ সালের পরও বাদামতলীর এই বাজারে মূলত দেশি মৌসুমি ফল বেচাকেনা হতো। আতর মিয়া, কালু মিয়া ও আবদুর রাজ্জাক- এ তিনজন এখানে দেশি ফলের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এখন বাজারটি বিদেশি ফলনির্ভর। এখানে ফল আসে ভারত, চীন, ভুটান, সৌদি আরব, দুবাই, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, জর্ডান, ফিলিপাইন, কুয়েত, ইরান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। এসব ফলের মধ্যে কমলা, খেজুর, মাল্টা, আঙুর, আপেল, আনার ও নাশপাতি বেশি আসছে। দেশি ফলের মধ্যে রয়েছে আম, লিচু, আনারস, তরমুজ, পেয়ারাসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এ বাজারের সাপ্তাহিক বন্ধ নেই বলে জানান সাধারন কর্মচারীরা ।