সিএনএমঃ
বহুল আলোচিত ২০০৬ সালে কেরানীগঞ্জের রোহিতপুর ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার আনোয়ার হোসেন’কে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যাকান্ডের ঘটনায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত প্রধান আসামি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান কামাল উদ্দীন’কে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
২০০৬ সালের ০১ ফেব্রæয়ারি রোহিতপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন (৫০)’কে কেরানীগঞ্জের সৈয়দপুর ঘাটে কতিপয় সন্ত্রাসী দেশিয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে গুরুতর জখম করে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে স্থানীয়রা ভিকটিমকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করেন এবং ঐ দিন রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভিকটিম আনোয়ার মৃত্যুবরণ করেন। উক্ত হত্যাকান্ডের ঘটনায় ভিকটিমের স্ত্রী বাদী হয়ে ১৩ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরো কয়েকজনকে আসামি করে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নম্বর-০২, তারিখ ০৩ ফেব্রæয়ারি ২০০৬। একজন ইউপি সদস্য হত্যাকান্ডের ঘটনায় তখন এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের তৈরী হয়েছিল এবং বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় গুরুত্বের সাথে প্রচারিত হয়েছিল। দায়েরকৃত হত্যা মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষে তদন্তকারী কর্মকর্তা গত ৩১ মে ২০০৮ তারিখ হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ও নেতৃত্ব প্রদানকারী সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিনসহ ০৮ জনের বিরুদ্ধে বিজ্ঞ আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন। পরবর্তীতে বিজ্ঞ আদালত গত ২৫ আগস্ট ২০০৯ তারিখ বিচারিক কার্যক্রম শেষে পলাতক আসামি কামাল উদ্দিনসহ ০২ জনকে মৃত্যুদন্ডাদেশ, ০৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং ০৩ জনকে খালাস প্রদান করেন। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের গ্রেফতারের লক্ষ্যে র্যাব নজরদারী অব্যাহত রাখে।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে র্যাব-১০ এর একটি আভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব-৯ এর সহযোগিতায় হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে বহুল আলোচিত ২০০৬ সালে কেরানীগঞ্জের রোহিতপুর ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার আনোয়ার হোসেন’কে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যাকান্ডের ঘটনায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক প্রধান আসামি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান কামাল উদ্দীন (৬৪), পিতাঃ মৃৃত কদম আলী, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা’কে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত কামাল উদ্দীন ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন হত্যাকান্ডে তার সম্পৃক্ততার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে।
নিহত ভিকটিম বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন কেরানীগঞ্জের রোহিতপুর ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি মেম্বার ছিলেন। পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে আড়তদারী ব্যবসা করতেন। বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসী কার্যক্রম, মাদকসহ বিভিন্ন ধরণের অপরাধ, ভ‚মি দস্যুতাসহ বিভিন্ন অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করতেন বিধায় কেরানীগঞ্জের রোহিতপুরের তরুণ ও যুব সমাজের মাঝে তার ভাল জনপ্রিয়তা ছিল। একারণে তিনি স্থানীয় সন্ত্রাসী ও ভ‚মি দস্যুদের শত্রæতে পরিণত হয়। গত ০১ ফেব্রæয়ারি ২০০৬ তারিখ স্থানীয় সন্ত্রাসীরা তাকে দেশিয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। গুরুতর আহত অবস্থায় ভিকটিম আনোয়ার হোসেনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে সন্ধ্যায় তাকে রাজধানীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। অতঃপর রাতে সেখান থেকে এ্যাপোলো হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তীতে ভোরবেলায় এ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আনোয়ার হোসেন মৃত্যুবরণ করেন।
মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ও জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, কেরাণীগঞ্জের রোহিতপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কামাল উদ্দীন এর পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয়। কামাল উদ্দীন ইউপি চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে এলাকায় একটি সন্ত্রাসী দল গঠন করে এবং অবৈধ বালুর ব্যবসা, জোরপূর্বক ভূমি দখল, ত্রাণের মালামাল কুক্ষিগত করা ও এলাকায় বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করতো। ভিকটিম আনোয়ার হোসেন বিভিন্ন সময়ে তার বিভিন্ন অবৈধ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমে প্রতিবাদ করতো। গ্রেফতারকৃত কামালের এরূপ অবৈধ ও অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করায় ভিকটিম আনোয়ার স্থানীয়দের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। গ্রেফতারকৃত কামালের অবৈধ বালুর ব্যবসা ও ভ‚মি দস্যুতা নিয়ে তৎকালীন বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পিছনে ভিকটিম আনোয়ার হোসেনের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে ধারণা করে গ্রেফতারকৃত কামাল। এজন্য ভিকটিম আনোয়ারের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে ও এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে ভিকটিম আনোয়ারকে উচিত শিক্ষা দেয়ার পরিকল্পনা করে গ্রেফতারকৃত কামাল। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভিকটিম আনোয়ার গত ০১ ফেব্রæয়ারি ২০০৬ তারিখ সৈয়দপুর ঘাটে মাছের আড়তে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে নদী পার হওয়ার উদ্দেশ্যে নৌকায় উঠার সময় গ্রেফতারকৃত কামাল এর নেতৃত্বে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ০৮-১০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল দেশিয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে ভিকটিম আনোয়ার হোসেনের শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাথারি কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। একপর্যায়ে ভিকটিম আনোয়ার হোসেনের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে গ্রেফতারকৃত কামালসহ তার সন্ত্রাসী দল দ্রæত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।
জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায় যে, বর্ণিত হত্যাকান্ডের পর ভিকটিমের স্ত্রী কর্তৃক কেরাণীগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়েরের খবর পেয়ে গ্রেফতারকৃত কামাল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেফতার এড়াতে দেশের বিভিন্ন স্থানে আতœগোপনে থেকে ২০০৭ সালে কৌশলে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে গমন করে। অতঃপর দীর্ঘ ১৬ বছর পর ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসে নিজের পরিচয় গোপন রেখে সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বসবাস শুরু করে এবং পুনরায় সেখানে বিয়েও করেছেন বলে জানায়। মূলত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেফতার এড়াতে সে বারবার তার অবস্থান পরিবর্তন করে আত্মগোপনে থাকতো বলে জানা যায়। সর্বশেষ হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ এলাকায় আত্মগোপনে থাকাকালীন অবস্থায় র্যাব কর্তৃক গ্রেফতার হয়।