মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করা ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির দুই জ্যেষ্ঠ নেতা মুখপাত্র নুপুর শর্মা ও নবীন জিন্দলকে শাস্তি দিয়ে এখন উভয় সংকটে বিজেপি। বিতর্কিত মন্তব্যের পর নুপুরের পাশ থেকে দল সরে যাওয়ায় দলের তৃণমূল কর্মীদের ক্ষোভ বুঝতে পারছেন বিজেপির শীর্ষ নেতারা।
সেই ক্ষোভের আঁচ তারা টের পাচ্ছেন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে। প্রকাশ্যে নুপুরের সমর্থনে সরব হয়েছেন বিজেপি কর্মী ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো। তাদের দাবি, নুপুর যা করেছেন তা দলের জন্যই করেছেন। অথচ, তার যখন দলের ‘সমর্থনের প্রয়োজন’ ছিল, তখন তাকে সাসপেন্ড করা হল। আর এই যখন অবস্থা তখন কর্মীরা আগামী দিনে কোন ভরসায় মাঠে নামবেন বা মুখ খুলবেন— সেই উত্তরও চেয়েছেন অনেকে।
অবশ্য কর্মীদের ক্ষোভ বুঝতে পারলেও এখনই কিছু করার নেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহদের। কারণ, আন্তর্জাতিক স্তরে নুপুর-মন্তব্যে যে ভাবে ভারতের মুখ পুড়েছে, তাতে তৃণমূল কর্মীদের ক্ষোভ প্রশমনের রাস্তায়ও হাঁটতে পারছে না বিজেপি নেতৃত্ব।
পরিস্থিতি যাতে আরও ঘোলাটে না হয়, সে দিকেও সতর্ক বিজেপি। দলের যে সকল নেতাদের বিরুদ্ধে অতীতে হিংসাত্মক ভাষণ বা ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছিল, তাদেরও সতর্ক করেছে ভারতের ক্ষমতাসীন এই দলটি।
ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সাবেক মুখপাত্র নুপুর শর্মা এক টেলিভিশন শোতে অংশ নিয়ে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে বিতর্কিত ওই মন্তব্য করেছিলেন। পরে দলটির নয়াদিল্লি শাখার গণমাধ্যম প্রধান নবীন জিন্দালও নুপুর শর্মার মন্তব্যের সমর্থনে টুইট করেন।
তাদের এই মন্তব্য দেশটির সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে ক্ষুব্ধ করে তোলে। এমনকি অভিযুক্তদের মন্তব্যের জেরে ভারতের কয়েকটি রাজ্যের মুসলিমরা বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন। আর এর রেশ ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাইরের বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
অবশ্য এরপরই অনেকটা নড়েচড়ে বসে বিজেপি। পরিস্থিতি বিবেচনায় বিজেপি গত রোববার অভিযুক্ত নুপুর শর্মাকে বরখাস্ত এবং জিন্দালকে বহিষ্কার করা করে। এমনকি পরে বিজেপির এই দুই নেতা প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে বিবৃতিও দিয়েছেন।
কিন্তু এরপরও বিজেপির জ্যেষ্ঠ দুই নেতার বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে মুসলিম বিশ্বের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ ও তোপের মুখে পড়েছে ভারত। মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশগুলোসহ এখন পর্যন্ত বিশ্বের অন্তত ১৫টি দেশ ভারতের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। এসব দেশ ভারত ও বিজেপি সরকারের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি দেশটিকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য ঘিরে ইরান, ইরাক, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, আফগানিস্তান, বাহরাইন, মালদ্বীপ, লিবিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া-সহ অন্তত ১৫টি দেশ ভারতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে।
একইসঙ্গে এই দেশগুলো নিন্দা জানানোর পাশাপাশি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অপমান প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ভারত সরকারকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়েছে।
বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে অভিযুক্ত নুপুর শর্মাকে বরখাস্ত এবং জিন্দালকে বহিষ্কারের পর দলের তৃণমূল কর্মীরা দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এ ভাবে প্রকাশ্যে সরব হওয়ায় রীতিমতো অস্বস্তিতে পড়েছে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়ে বিজেপি যুব মোর্চার আইটি শাখার নেতা অভিষেক দুবের টুইট, ‘কোনো ধর্ম বা ধর্মীয় নেতাকে অপমান করা ব্যক্তিগত ভাবে সমর্থন করি না। কারণ প্রত্যেকের বিশ্বাস আলাদা।’
বিজেপি নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন, তৃণমূলের কর্মীদের বড় একটি অংশ নুপুর-নবীনের শাস্তি ‘ভালো ভাবে’ নেয়নি। তারা মনে করছেন, দল ওই দুই মুখপাত্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আক্রমণের মুখে পড়া ওই দুই মুখপাত্রকে যখন দলের আড়াল করা উচিত ছিল, তখন তাদের শাস্তি দিয়ে আরও কঠিন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
বিহারের এক বিজেপি কর্মীর প্রশ্ন, ‘এরপরে কার ভরসায় দল করব? দল যদি বাঁচাতে না আসে তা হলে এমন দল করে লাভ কী?’
অন্যদিকে বিজেপির একাংশ মনে করছে, কোথাও একটি সীমারেখা টানার প্রয়োজন ছিল। যাতে দলীয় কর্মীদের কাছে কড়া বার্তা দেওয়া সম্ভব হয়। নুপুর-নবীনকে শাস্তির মাধ্যমে দলীয় কর্মীদের গণ্ডির মধ্যে থাকার বার্তা দিয়েছে দল। পাশাপাশি, কানপুরে নুপুর শর্মার মন্তব্যে হওয়া সহিংসতায় উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে স্থানীয় বিজেপি যুব শাখার এক কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
নুপুর-নবীনকে শাস্তির পাশাপাশি যাদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক ভাষণের অভিযোগ রয়েছে, এমন ২৭ জনের তালিকা তৈরি করেছে বিজেপি। অনন্ত কুমার হেগড়ে, প্রতাপ সিনহা, মহেশ শর্মা, বিনয় কাটিয়ার, সাক্ষী মহারাজ, গিরিরাজ সিং, সঙ্গীত সোম রয়েছেন ওই তালিকায়।
ওই নেতাদের আপাতত কিছু দিন যেকোনো ধরনের বিতর্কিত মন্তব্য করতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বিজেপি।
আনন্দবাজার অবলম্বনে