তিস্তা নদীর অনেকটা বিচ্ছিন্ন জনপদ রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী ইউনিয়নের চরবাগডহড়া গ্রাম। যুগ যুগ ধরে চরে আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে একটি সন্ত্রাসী চক্র খুন-খারাবি, অপহরণ, বাড়িঘর, হাট-বাজার, দোকানপাট ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াওসহ নানা নৃশংস কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। এখানে ওই সন্ত্রাসী চক্রের কথার অবাধ্য হলেই নেমে আসে সীমাহীন বর্বরতা। চরের জমি জবর-দখলকে কেন্দ্র করে এই চরে এ পর্যন্ত ৭ জন নিরীহ মানুষ হত্যার শিকার হয়েছেন। একাধিক হত্যাকাণ্ডের হোতা সাবেক ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম আজও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। এসব নিয়ে এলাকাবাসী চরম উৎকণ্ঠায় থাকে।
পুলিশ, ভুক্তভোগী ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, নোহালী ইউনিয়নের চরবাগডহড়া ৮নং ওয়ার্ডে টানা দুবার ইউপি সদস্য ছিলেন সাইফুল ইসলাম। তার বাহিনীর নিপীড়ন, নির্যাতন, দখলবাজিতে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী আজিজুল ইসলামকে ইউপি সদস্য নির্বাচিত করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন সাইফুল। নির্বাচনে হেরে শুরু হয় তার নেতৃত্বে এলাকায় তাণ্ডব। জুলুম নেমে আসে স্থানীয় ভোটারদের ওপর। গত বছরের ৬ এপ্রিল সাইফুলের নেতৃত্বে ইউপি সদস্য আজিজুল ইসলামের ওপর হামলা চালানো হয়। প্রাণে বাঁচতে আজিজুল স্থানীয় মমিন আলীর বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে ঢুকে সাইফুলের লোকজন আজিজুল ইসলামকে টেনে-হেঁচড়ে বের করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। ঘটনায় পরদিন নিহতের ছেলে বর্তমান ইউপি সদস্য রেজাউল হক (বুলেট) বাদী হয়ে গঙ্গাচড়া মডেল থানায় মামলা করেন। আজিজুল মেম্বার হত্যাকাণ্ড ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য সেদিনই ওই মামলায় গ্রেফতারকৃত সাইফুলের সহযোগী শফিকুলের চাচাতো ভাই ৮৬ বছরের বৃদ্ধ ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত রেয়াজুল ইসলামকে বাড়ি থেকে বের করে গলা কেটে ও বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। পরে রেয়াজুল হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী তার একমাত্র নাতনি মোনালিসাকেও (১৪) শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। সেদিনই সাইফুল নিজের অপরাধ আড়াল করতে উল্টো নিহত আজিজুল মেম্বারের পরিবারের লোকজনের বিরুদ্ধে পাল্টা একটি মামলা করান।
মোনালিসার বাবা জিয়ারুল ইসলাম জিয়া গত বছরের ২০ ডিসেম্বর রংপুরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কৃষ্ণ কমল রায়ের কাছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। তিনি আদালতকে বলেছেন, খুনিরা তাদের দিয়ে বাধ্য করতে চেয়েছিল তারা (নিহত মোনালিসার পরিবার) যেন বলে মেয়ে পেটব্যথায় মারা গেছে। মোনালিসার গলায় আঙুলের ছাপ স্পষ্ট থাকলেও পেটের ব্যথায় আত্মহত্যা করেছে বলে গঙ্গাচড়া থানা পুলিশ লাশের সুরতহাল তৈরি করে। তিনি আরও বলেছেন, মেয়ের হত্যা ঘটনায় মামলা করতে গঙ্গাচড়া থানায় গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। বলেছে কোর্টে যান। জিয়ারুল ইসলাম সন্ত্রাসী বাহিনীর হুমকির কারণে এখন চরবাগডহড়া গ্রাম ছেড়ে গঙ্গাচড়ার কচুয়া এলাকায় বসবাস করছেন।
এদিকে গঙ্গাচড়া থানার দুটি মামলা সম্পর্কে রংপুর জেলা সিআইডি গণমাধ্যম কর্মীদের একটি প্রেস নোট দেয়। এতে বলা হয়Ñ প্রথম মামলায় গ্রেফতারকৃত শফিকুল ইসলামের দেওয়া তথ্য মতে তাকে নিয়ে সিআইডি টিম ঘটনাস্থলে যায়। সেখানে শত শত মানুষের সামনে হামলার ঘটনায় ব্যবহৃত লাঠি, ছুরি, বল্লম, হাসুয়া উদ্ধার করে। পুলিশের ব্যাপক তদন্ত, সাক্ষ্যপ্রমাণ ও আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে সিআইডির তদন্তে উদঘাটিত হয়েছে যে, ৭ ও ৮নং মামলার দুটি খুনই সাইফুল ইসলাম ও তার লোকদের দিয়ে সংঘটিত হয়েছে। এ পর্যন্ত জোড়া খুনের মামলায় বিভিন্ন সময়ে ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বর্তমানে ১২ জন জেলহাজতে রয়েছে।
এ ব্যাপারে গঙ্গাচড়া মডেল থানার থানার সদ্য বদলি হওয়া ওসি সুশান্ত সরকার বলেন, আমরা মোনালিসার বাবাকে ডেকেছি। কিন্তু তিনি আসছেন না। তিনি চাইলে মেয়েকে হত্যার অভিযোগে মামলা নেওয়া হবে।