ইউক্রেনে পশ্চিমাদের অস্ত্র সরবরাহের অজুহাত হিসেবে প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, কিয়েভকে আত্মরক্ষায় সহায়তা দেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য। তবে এখন তারা বলছে, কেবল ইউক্রেনে রাশিয়ার পরাজয় নিশ্চিত করা নয়, সামগ্রিকভাবে ক্রেমলিনকে সামরিকভাবে দুর্বল করে দিতে চায় তারা। মঙ্গলবার ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরও একধাপ এগিয়ে বলেছেন, রাশিয়ার অভ্যন্তরে ইউক্রেনের হামলা বৈধ। এইসব মন্তব্যের ধারাবাহিকতায় রাশিয়ার অভ্যন্তরে সম্প্রতি বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, যাকে ইউক্রেনীয় হামলা বলে মনে করা হচ্ছে। বুধবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষ থেকে যুক্তরাজ্যকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়েছে, ইউক্রেনকে উসকানি দেওয়ার পরিণাম ভালো হবে না। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পশ্চিমা মদদেই ইউক্রেন রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা চালাতে সমর্থ হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের উসকানি ও রাশিয়ার হুমকি : রোববার কিয়েভে এক সফর শেষ করে পোল্যান্ডে ফিরে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল লয়েড অস্টিন খোলাখুলি বলেছেন শুধু এই যুদ্ধে পরাজয় নয়, রাশিয়ার সামরিক শক্তি চিরতরে দুর্বল করে দেওয়াই এখন যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য। জেনারেল অস্টিনের এই বক্তব্যের পরদিন ক্ষুব্ধ রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটও এখন রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। সোমবার রাতে রুশ টিভি চ্যানেল রাশিয়া ফার্স্টে এক সাক্ষাৎকারে ল্যাভরভ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো জোট যদি ইউক্রেনকে ঢালাওভাবে অস্ত্র দেওয়া বন্ধ না করে তাহলে পারমাণবিক সংঘাত এবং তার জেরে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে পারে।
এদিকে মঙ্গলবার ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস হিয়েপ্পি বিবিসি রেডিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইউক্রেনে অভিযানরত রুশ সেনাবাহিনীর অস্ত্র ও রসদের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করতে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন স্থাপনায় যদি ইউক্রেনীয় সেনারা হামলা করে, সেক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ যৌক্তিক হবে বলে মনে করে ব্রিটেনের সরকার।
রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা : ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী রাশিয়ার তিনটি প্রদেশে ধারাবাহিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে এবং প্রায় একই সময় বেলগোরোদ প্রদেশে একটি গোলাবারুদের ডিপোতে আগুন লেগেছিল বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। বুধবার দিন শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এসব ঘটনা ঘটে বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। কিয়েভকে এইসব হামলায় দায়ী করা হচ্ছে।
কী বলছেন বিশ্লেষকরা : ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়া নিয়ে এতদিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো জোটের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, এর উদ্দেশ্য ইউক্রেনের আত্মরক্ষায় সাহায্য করা। তবে সম্প্রতি যে ধরনের অস্ত্র ইউক্রেনকে দেওয়া হচ্ছে বা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে তাতে ন্যাটোর সেই লক্ষ্যে পরিবর্তনের আভাস স্পষ্ট হয়ে উঠছে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মুখ থেকে রোববারের বক্তব্যের পর অনেক বিশ্লেষকই প্রশ্ন তুলছেন যুক্তরাষ্ট্রর লক্ষ্য কি ইউক্রেনের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সাহায্য করা নাকি এই সুযোগে রাশিয়াকে ঘায়েল করা।
বিবিসির কূটনৈতিক সংবাদদাতা জেমস ল্যান্ডেল বলছেন, এমন সব অস্ত্র এখন ইউক্রেনকে দেওয়া হচ্ছে যা দিয়ে রাশিয়ার ভেতরেও হামলা চালানো যাবে। দুদিন আগে তার একটি নমুনাও দেখা গেছে যেখানে ইউক্রেন সীমান্ত থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার দূরে রাশিয়ার একটি শহরে দুটো তেলের ডিপোতে বিস্ফোরণের পর আগুন ধরে যায় এবং ধারণা করা হচ্ছে ইউক্রেন থেকে ছোড়া দূরপাল্লার কামানের গোলাতেই এই অগ্নিকাণ্ড হয়েছে।
মঙ্গলবার রাতেও ইউক্রেন সীমান্ত থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে রাশিয়ার বেলগোরোদ নামের একটি শহরেও অস্ত্রগুদামে বিস্ফোরণের যে খবর পাওয়া গেছে, তা নিয়ে জেমস ল্যান্ডেল বলছেন, ‘ইউক্রেনকে আত্মরক্ষায় সাহায্য করা আর রাশিয়াকে হামলার মধ্যে পার্থক্যটা ক্রমেই ধোঁয়াশে হয়ে যাচ্ছে’। মার্কিন কর্মকর্তাদের মুখ থেকে ঘন ঘন এখন শোনা যাচ্ছে- এই যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় অনিবার্য।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়ার পরাজয় নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ন্যাটো মিত্ররা যদি ইউক্রেনকে ভারী অস্ত্র-সরঞ্জাম, রসদ জুগিয়ে চলে এবং বাড়িয়ে যেতে থাকে- যে ইঙ্গিত তারা স্পষ্টভাবেই দিচ্ছে- তাহলে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সামনে রাস্তা কী? ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক হামলা শুরুর নির্দেশ দেওয়ার সময় পুতিন হুমকি দিয়েছিলেন, ‘কোনো পশ্চিমা শক্তি যদি এই যুদ্ধে সরাসরি মাথা গলায় তাহলে তাদের এমন পরিণতি ভোগ করতে হবে যা ইতিহাসে আগে দেখা যায়নি।’
যুক্তরাষ্ট্র যে সেই হুমকিতে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছে তার কোনো লক্ষণ নেই। রাশিয়ার সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ এড়িয়ে চললেও রাশিয়ার ওপর যেভাবে নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এবং ইউক্রেনকে যেভাবে ক্রমাগত অস্ত্র দেওয়া হচ্ছে সেটাকে অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষকও রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে ছায়াযুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করছেন।
যুক্তরাষ্ট্র একাই গত দুই মাসে ইউক্রেনকে ৩৫০ কোটি ডলারের অস্ত্র সাহায্য দিয়েছে। আরও সাতশ কোটি ডলারের অস্ত্র সাহায্য সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট বাইডেন অনুমোদন করেছেন যা দিয়ে দূরপাল্লার কামান, মাল্টিপল রকেট লঞ্চার এবং সাঁজোয়া ড্রোনের মতো অত্যাধুনিক অস্ত্র দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
এ ধরনের ‘স্পর্শকাতর’ অস্ত্র যেন ইউক্রেনকে না দেওয়া হয় তা নিয়ে রাশিয়া এ মাসের মাঝামাঝি লিখিতভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং বেশ কয়েকটি ন্যাটো দেশকে সাবধান করে। ওই চিঠিতে সতর্ক করা হয়, ‘অত্যন্ত স্পর্শকাতর’ এসব অস্ত্র ইউক্রেনে পাঠানো হলে ‘অজানা পরিণতি’ ভোগ করতে হতে পারে।
এই হুমকিতেও যে যুক্তরাষ্ট্র কান দিয়েছে তার কোনো লক্ষণ নেই। কারণ রাশিয়ার ওই চিঠি পাওয়ার ১০ দিনের মাথায় ইউক্রেনকে সমন্বিতভাবে অস্ত্র সাহায্য দেওয়া নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার জার্মানিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৪০টি দেশের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের ডেকে এনে এক বৈঠক শুরু করেছে। এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ইউক্রেন যুদ্ধের পরের ধাপে দেশটিকে কীভাবে আরও দীর্ঘমেয়াদে এবং আরও বেশি সামরিক সহায়তা দেওয়া যায়।
জার্মানি বহু বছর ধরে কোনো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে ভারী অস্ত্র না পাঠানোর নীতি অনুসরণ করত। তবে ইউক্রেনের বেলায় একই নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে জার্মানি বেশ সমালোচনার মুখে পড়ে। এখন তারা সেখান থেকে সরে আসতে যাচ্ছে। জার্মান সরকার এই প্রথম ইউক্রেনের কাছে বিমানবিধ্বংসী ট্যাঙ্ক বিক্রির বিষয়টি অনুমোদন করেছে। মঙ্গলবার জার্মানি বলেছে, তারা রাডারযুক্ত কয়েক ডজন ট্যাঙ্ক দেবে যা দিয়ে বিমান ধ্বংস করা যায়।
ন্যাটোর অন্য দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স, তারা ইতোমধ্যে ইউক্রেনকে ভারী সামরিক সাজ-সরঞ্জাম দেওয়া শুরু করেছে। ফরাসিরা দিচ্ছে কিছু সিজার কামান, যেগুলোর রেঞ্জ হচ্ছে প্রায় ৪০ কিলোমিটার। আর ব্রিটেন দিচ্ছে স্টারস্ট্রেক এন্টি এয়ারক্রাফট ক্ষেপণাস্ত্র এবং ট্যাঙ্ক। এই বৈঠক শুরুর দিন অর্থাৎ সোমবারই ব্রিটেন ঘোষণা করেছে, তারা স্টারট্রেক বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র যুক্ত সাঁজোয়া গাড়ি পাঠাবে ইউক্রেনে।