ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় এক নম্বর আসামি নিউমার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি মকবুল হোসেনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
অন্যদিকে ওই হামলার ঘটনায় সূত্রপাত হওয়া জড়িত তিন শিক্ষার্থী ও দুই দোকান কর্মচারীকে চিহ্নিত করেছেন গোয়েন্দারা। এদের মধ্যে তিন শিক্ষার্থীকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। আর দুই দোকান কর্মচারী গোয়েন্দাজালে রয়েছেন বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট ও গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছেন। তবে তারা কোথায় রয়েছে স্বজনরা তা নিশ্চিত হতে পারেননি বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
শনাক্ত হওয়া তিন শিক্ষার্থী হলো ছাত্রলীগ কর্মী ও ঢাকা কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী নাসিম, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের লিটন ও পদার্থবিদ্যা বিভাগের আবদুল্লাহ আল মাসউদ। ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি না থাকলেও চিহ্নিত তিনজন ক্যাম্পাস ও হলে ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবেই পরিচিত।
আর দুই দোকান কর্মচারী হলো নিউমার্কেটের ওয়েলকাম ফাস্টফুড দোকানের কর্মচারী বাপ্পী ও ক্যাপিটাল ফাস্টফুডের কর্মী কাওসার। এই দুইজন বর্তমানে গোয়েন্দাজালে রয়েছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে। তাদের দুজনের বাসা রাজধানীর রায়েরবাজার এলাকায়।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, শনাক্ত হওয়া তিন শিক্ষার্থীর কাউকে আটক করা যায়নি। তারা ঘটনার পরপরই মোবাইল বন্ধ রেখেছে। তাদের ঢাকা কলেজের ছাত্রাবাসেও পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে দোকান কর্মচারী মুরসালিন নিহতের ঘটনায় হত্যা মামলা হয়েছে। শুক্রবার নিউমার্কেট থানায় মামলাটি হয়। এর আগে সংঘর্ষের ঘটনায় নাহিদ হত্যাকাণ্ডের মামলা এবং মুরসালিন হত্যা মামলা এই দুই মামলার তদন্তভার পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
বিএনপির সাবেক নেতা মকবুল গ্রেফতার : শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, গতকাল বিকালে মকবুল হোসেনকে তার ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারের পর তাকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গোয়েন্দা তদন্ত রিপোর্ট বলছে, ঘটনা শুরুর পর থেকে সংঘর্ষ ছড়িয়ে দিতে ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থী দুই মহলকেই উস্কে দিয়েছেন মকবুলসহ আরও কয়েকজন বিএনপি নেতাকর্মী। যে দুই ফাস্টফুডের কর্মচারীর বিবাদে ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল সেই ওয়েলকাম ও ক্যাপিটাল নামে দোকান দুটির মালিক এই মকবুল। তবে কোনো দোকানই মকবুল নিজে চালাতেন না। রফিকুল ইসলাম ও শহিদুল ইসলাম নামে দুজনকে ভাড়া দেন দোকান দুটি। রফিকুল ও শহিদুল তারা পরস্পর চাচাতো ভাই।
গোয়েন্দা সূত্র ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জানায়, ঢাকা কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের নাসিমের গায়ে জার্সি লেখা রয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী লিটনের গায়ে পরা ছিল মেরুন রঙের শার্ট। আর পদার্থবিদ্যা বিভাগের আবদুল্লাহ আল মাসউদের গায়ে ছিল সবুজ রঙের টিশার্ট।
গোয়েন্দা সূত্র আরও জানায়, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, মার্কেটের চার নম্বর গেটের ওয়েলকাম ফাস্টফুডের কর্মচারী বাপ্পী ও ক্যাপিটালের কর্মচারী কাওসারের মধ্যে সন্ধ্যায় কথা কাটাকাটি থেকেই সংঘর্ষের শুরু হয়। ইফতারের সময় নিউমার্কেটের ভেতরে হাঁটার রাস্তায় টেবিল পেতে বসে ইফতারের ব্যবস্থা করে ফাস্টফুডের দোকানগুলো। মূলত এ বিরোধের সূত্রপাত ওয়েলকাম ফাস্টফুডের দুই কর্মচারীর মধ্যে। বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে কাওসারকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে বাপ্পী ওই জায়গা থেকে চলে যায়। ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, রাত সাড়ে ১১টায় বাপ্পী ঢাকা কলেজ থেকে তার পরিচিতদের নিয়ে আসে। এ সময় নাসিম, লিটন ও আবদুল্লাহ আল মাসউদের নেতৃত্বে ঢাকা কলেজের কিছু শিক্ষার্থী ক্যাপিটাল ফাস্টফুডের কর্মীদের মারধর শুরু করে। একপর্যায়ে ক্যাপিটাল ফাস্টফুডের কর্মীরা নিজেদের দোকানের ছুরি, চাকু নিয়ে পাল্টা হামলা চালায়। পরে আহত হয়ে পালিয়ে যায় ঢাকা কলেজ থেকে আসা দলটি। তবে তারা কলেজে গিয়ে বলে, ব্যবসায়ীরা তাদের ওপর হামলা করেছে। এ কারণে কলেজ থেকে আরও ছাত্র নিয়ে এসে নিউমার্কেটে ফের হামলা চালায় শিক্ষার্থীরা।
মুরসালিনের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা : মুরসালিনের মৃত্যুর ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে তার ভাই নুর মোহাম্মদ হত্যা মামলা করেন। মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৮ জুন দিন ধার্য করেছেন আদালত। শুক্রবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলাম মামলার এজাহার গ্রহণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এ দিন ধার্য করেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুর ১টায় মুরসালিনের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক ডা. মনিকা খন্দকার।
ঢামেক হাসপাতাল মর্গ সূত্রে জানা যায়, আঘাতের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মুরসালিনের মৃত্যু হয়েছে। মুরসালিন কুমিল্লার তিতাস উপজেলার বাতাকান্দি গ্রামের মো. মানিক মিয়ার ছেলে। বর্তমানে কামরাঙ্গীরচরের ঝাউলাহাটি চৌরাস্তা এলাকায় থাকতেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে মুরসালিন দ্বিতীয়। এ ছাড়া মুরসালিন এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তার স্ত্রীর নাম মিতু আক্তার।
গতকাল বিকালে নিউমার্কেট থানার ওসি শ ম কাইয়ুম বলেন, নাহিদ নিহতের ঘটনায় বুধবার রাতে তার চাচা মো. সাইদ যে হত্যা মামলা করেছেন, তা গোয়েন্দা রমনা বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া দোকান কর্মচারী মুরসালিন নিহতের মামলাটিও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
শ ম কাইয়ুম বলেন, মুরসালিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে একশ থেকে দেড়শজনকে। এর আগে দায়ের করা তিন মামলায় ২৪ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা ১ হাজার ৪০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। চারটি মামলার মধ্যে দুটি মামলায় পুলিশ বাদী, অন্য দুটি মামলা নিহত মুরসালিন ও নাহিদের পরিবারের পক্ষ থেকে করা হয়েছে।
পুলিশ বাদী হয়ে দায়ের করা দুই মামলার তদন্ত নিউমার্কেট থানা পুলিশ তদন্ত করছে বলে জানিয়েছেন ওসি শ ম কাইয়ুম।
তিনি বলেন, নিউমার্কেটে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে যে দুটি মামলা করেছে তার তদন্ত করবে থানা পুলিশ। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য ও সিসি ক্যামেরা এবং অন্যান্য ভিডিও বিশ্লেষণ করে ঘটনায় জড়িতদের সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে।
ঢামেকে চিকিৎসাধীন দুজন আশঙ্কামুক্ত : সংঘর্ষের ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪০ জনের বেশি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। এখনও দুজন হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন। তারা দুজনই শিক্ষার্থী। তাদের শারীরিক অবস্থা আশঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
উল্লেখ্য, গত ১৭ এপ্রিল রাত ১১টার দিকে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী ও দোকানকর্মীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টা চলে এ সংঘর্ষ। এরপর রাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও মঙ্গলবার সকাল ১০টার পর থেকে ফের দফায় দফায় শুরু হয় সংঘর্ষ, পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দফায় দফায় সংঘর্ষ চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এতে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হয়।