ধারাবাহিকভাবে কমছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৪৪ হাজার ২৭০ কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এ সময়ে পুরনো সঞ্চয়পত্রের মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধ করা হয়েছে ৩৪ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। এ খাতে সরকারের নিট ঋণ এসেছে ১০ হাজার ২৫ কোটি টাকা। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ হাজার ১৯ কোটি টাকা বা প্রায় ৫৩ শতাংশ কম। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনের এসব তথ্য জানা গেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতিমাত্রায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে নানা শর্ত জুড়ে দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে সুদহার কমানো হয়েছে। আবার ঘোষণার বাইরে সঞ্চয়পত্র থাকলে জেল-জরিমানার বিধান করা হয়েছে। এ কারণে অনেকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমিয়েছেন।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাত থেকে সরকার নিট ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে। প্রথম পাঁচ মাসে অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার ৩১ শতাংশ ঋণ নেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি বছরের একক মাস নভেম্বরে সরকার মোট আট হাজার ৯৪১ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেছে। এর মধ্যে মূল টাকা ও মুনাফা পরিশোধ হয়েছে আট হাজার ২৪০ কোটি টাকা। মূল অর্থ পরিশোধের পর অবশিষ্ট অর্থ নিট বিক্রি হিসেবে গণ্য হয়। সেই হিসাবে আলোচিত সময়ে নিট বিক্রির পরিমাণ ৭০১ কোটি টাকা।
একদিকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে গেছে। অন্যদিকে, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, সুদ পরিশোধসহ বিভিন্ন কাজে ব্যয় বেড়েছে। ফলে রাজস্ব আয় ও বিদেশি অর্থ ছাড় বাড়লেও ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (১ জুলাই থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে সরকার ১৮ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে ফলে ৩০ ডিসেম্বর শেষে সরকারের ব্যাংক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ২০ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা, যা গত ৩০ জুনে ছিল দুই লাখ দুই হাজার ১১৫ কোটি টাকা।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে অনুদান ছাড়া দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ। বাজেটের আয়-ব্যয়ের বিশাল ঘাটতি পূরণে প্রধান ভরসাস্থল ব্যাংক খাত। এবারও ঘাটতি পূরণে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। এর আগের অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্য থাকলেও এর বিপরীতে সরকার নিয়েছিল মাত্র ২৬ হাজার ৭৮ কোটি টাকা।
সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ও এর ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে সরকার। চলতি বাজেটে দুই লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র বা পোস্টাল সেভিংস কিনতে হলে কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়া পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র মিলবে শুধু সঞ্চয় অধিদফতরে।
সব শেষ গত ২১ সেপ্টেম্বর সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে। সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার দুই শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে। তবে ১৫ লাখ টাকার নিচে মুনাফার হার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপন নির্দেশনা অনুযায়ী, পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে মেয়াদ শেষে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়। নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এখন থেকে যারা সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করবেন তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে। ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ থাকলে মুনাফার হার হবে নয় দশমিক ৩০ শতাংশ।
তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে মেয়াদ শেষে মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ। এখন ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার হার কমিয়ে করা হয়েছে ১০ শতাংশ। সঞ্চয়পত্রে যাদের বিনিয়োগ ৩০ লাখ টাকার বেশি তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন নয় শতাংশ হারে।
পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে এত দিন ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ হারে মুনাফা দেওয়া হতো। এখন এ সঞ্চয়পত্রে যাদের বিনিয়োগ ১৫ লাখ টাকার বেশি তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে। ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ থাকলে এ হার হবে নয় দশমিক ৭৫ শতাংশ।
দেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় পরিবার সঞ্চয়পত্র। পাঁচ বছর মেয়াদি এ সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। এখন এ সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার কমিয়ে করা হয়েছে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ। ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ হার নয় দশমিক ৫০ শতাংশ।
ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের সাধারণ হিসাবে বর্তমানে মুনাফার হার সাড়ে সাত শতাংশ। এতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে তিন বছর মেয়াদি হিসাবে বর্তমানে মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। এখন ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফার হার হবে ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ। ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে হবে নয় দশমিক ৩০ শতাংশ।