সিএনএম:
*বহুল আলোচিত মালয়েশিয়ায় উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার ১৯ যুবককে মায়ানমারে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি ও সেখানে বন্দীদশায় নির্যাতনের ফলে একজনের নির্মম মৃত্যুর ঘটনায় দায়ী আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের বাংলাদেশের মূলহোতা মোঃ ইসমাইলকে তার ২ সহযোগীসহ নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।*
গত ১৯ মার্চ ২০২৩ নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকার ১৯ জন যুবক মানব পাচার চক্রের মাধ্যমে টেকনাফ থেকে নৌ-পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় মায়ানমারের কোস্টগার্ড কর্তৃক আটক হয়। পরবর্তীতে ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা গত ১০ জুলাই ২০২৩ তারিখ নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্ত (ইউএনও) এর কার্যালয়ে গিয়ে তাদের স্বজনদের ফিরে পেতে সরকারি উদ্যোগ নেওয়ার আবেদন জানান। পরবর্তীতে উক্ত ঘটনায় আবুল কামলাম আজাদ বাদী হয়ে নারায়নগঞ্জের আড়াইহাজার থানায় একটি মানবপাচার আইনে মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নং-২১/১৪৯, তারিখ ১৫ এপ্রিল ২০২৩। এই চক্রের মাধ্যমে মালয়েশিয়া পাচার হওয়া জহিরুল ইসলাম গত ২৪ মে ২০২৩ তারিখ মালয়েশিয়ার একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে এবং গত ২৮ মে ২০২৩ তারিখ বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তার লাশ দেশে নিয়ে আসা হয়। উক্ত ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত হলে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচিত হয়। র্যাব উক্ত মানব পাচার চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য গোয়েন্দা নজদারী বৃদ্ধি করে।
শুক্রবার রাতে র্যাব-১১ এর একটি আভিযানিক দল নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের মূলহোতা ১। মোঃ ইসমাইল (৪৫), পিতাঃ আমির আলী, আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ ও তার সহযোগী ২। জসিম (৩৫), পিতাঃ আসমত আলী, আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ এবং ৩। মোঃ এলাহী (৫০), পিতাঃ মৃত বাতেন, আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জদেরকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা মানব পাচারের সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রদান করে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, গ্রেফতারকৃত ইসমাইল গত ২০০১-২০০৫ পর্যন্ত মালয়েশিয়া অবস্থানকালীন মায়ানমারের আরাকানের নাগরিক (রোহিঙ্গা) রশিদুল ও জামাল এর সাথে তার পরিচয় হয় এবং সখ্যতা গড়ে উঠে। পরবর্তীতে ইসমাইল দেশে ফিরে এসে মায়ানমারের আরাকানের নাগরিক (রোহিঙ্গা) রশিদুল এবং জামাল এর সাথে যোগসাজশে ১০-১২ জনের একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্র গড়ে তোলে ও স্থানীয় এজেন্টদের যোগসাজশে বাংলাদেশে মানবাপাচার চক্রটির শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকার তরুণ ও যুবকদেরকে কোন প্রকার অর্থ ও পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়া সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পৌছানো হবে এবং মালয়েশিয়া পৌছানোর পরে ৩ লক্ষ ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে প্রলোভন দেখাত। উক্ত টাকা গ্রেফতারকৃত ইসমাইল, জসিম ও আলম ৩০,০০০/-টাকা করে এবং চক্রের অন্য সদস্যরা ১০,০০০/-টাকা করে পেতো এবং বাকী ২,২০,০০০/-টাকা মালয়েশিয়া অবস্থানরত রশিদুলের নিকট মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংকের মাধ্যমে প্রেরণ করতো।
আরো জানা যায়, ভাগ্য পরিবর্তন ও উন্নত জীবন যাপনের আশায় যে সকল তরুণ ও যুবকরা মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছা পোষণ করত তাদেরকে জসিম ও এলাহীসহ চক্রের অন্য সদস্যরা উক্ত চক্রের মূলহোতা ইসমাইল এর নিকট নিয়ে আসতো। তারপর তাদেরকে নারায়ণগঞ্জ থেকে বাস যোগে কক্সবাজার জেলার টেকনাফের মানব পাচার চক্রের আরেক সদস্য আলমের নিকট হস্তান্তর করতো। টেকনাফের আলম ভুক্তভোগীদেরকে কয়েক দিন রেখে সুবিধাজনক সময়ে তাদেরকে ট্রলার যোগে মায়ানমারে জামালের নিকট পাঠিয়ে দেয়। পরবর্তীতে মায়ানমারের জামাল তার ক্যাম্পে ভোক্তভূগীদের রেখে নির্যাতন করে এবং তা ভিডিও করে গ্রেফতারকৃত ইসমাইলের মাধ্যমে ভোক্তভূগীদের পরিবারের কাছে পাঠিয়ে ৬ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি করত। মুক্তিপণ দেওয়া না হলে ভুক্তভোগীদের নির্মমভাবে পুনরায় নির্যাতন করা হত এবং যে সকল ভুক্তভোগীর পরিবার মুক্তিপনের টাকা প্রদান করে তাদেরকে মায়ানমার থেকে থাইল্যান্ডের সমুদ্র সীমা হয়ে মালয়েশিয়ায় রশিদুলের নিকট পাঠিয়ে দেয়। গ্রেফতারকৃত ইসমাইল নিজের ও অন্যান্য সদস্যদের অংশের টাকা রেখে অবশিষ্ট টাকা মালয়েশিয়া অবস্থানরত রশিদুলের নিকট মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংকের মাধ্যমে প্রেরণ করতো। পরবর্তীতে মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রশিদুল ও মায়ানমারে অবস্থানরত জামাল মুক্তিপনের টাকা তারা সমন্বয় করে ভাগ করে নিতো বলে জানা যায়। উল্লেখ্য রশিদুল প্রায় ২৫ বছর যাবৎ মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে এবং প্রায় ২০ বছর যাবৎ মানবপাচার চক্রের সাথে জড়িত রয়েছে বলে জানা যায়।
জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায় যে, এই চক্রটি গত ১৯ মার্চ ২০২৩ তারিখ সর্বমোট ২২ জনকে ট্রলার যোগে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাচার করার সময় মায়ানমার উপক‚লে পৌছালে মায়ানমার কোস্টাগার্ড কর্তৃক ১৯ জন গ্রেফতার হয় এবং অবশিষ্ট ০৩ জনকে এই চক্রের সদস্য মায়ানমারের জামাল কৌশলে ছাড়িয়ে তার ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে মুক্তিপনের জন্য নির্যাতন করে। তন্মধ্যে জহিরুলের পরিবারের নিকট ৬ লক্ষ টাকা মুক্তিপন দাবি করে। পরবর্তীতে জহিরুলের পরিবার গত ১০ মে ২০২৩ তারিখ ৪ লক্ষ ২০ হাজার টাকা মুক্তিপন প্রদান করে এবং অবশিষ্ট ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা মালয়েশিয়া পৌছানোর পর প্রদান করবে বলে জানায়। পরবর্তীতে ভিকটিম জহিরুলকে মে, ২০২৩ মাসের ২য় সপ্তাহে মায়ানমার হতে থাইল্যান্ডের সমুদ্র সীমা হয়ে সিঙ্গাপুরের পাশ দিয়ে মালয়েশিয়া (জোহার বারুত) পাঠানো হয়। নির্যাতনের কারণে সে অসুস্থ হয়ে পড়লে মালয়েশিয়া পুলিশের মাধ্যমে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। পরবর্তীতে গত ২৪ মে ২০২৩ তারিখ সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় তার মৃত্যু হয় এবং মৃত্যু সনদপত্রে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে তার শরীরে নির্যাতনের কথা উল্লেখ আছে বলে জানা যায়। পরবর্তীতে ২৮ মে ২৩ তারিখে বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং মালয়েশিয়া সরকারের তত্ত¡াবধানে জহিরুলের মৃতদেহ বাংলাদেশে এনে তার পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হয়। এছাড়াও মায়ানমার কোস্টগার্ড কর্তৃক আটককৃত ১৯ জনকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এর সাথে যোগাযোগ এর কার্যক্রম নারায়নগঞ্জ জেলা প্রশাসন এর মাধ্যমে চলমান রয়েছে।
গ্রেফতারকৃত ইসমাইল এই আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রটির বাংলাদেশের মূলহোতা। সে গত ২০০১-২০০৫ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়া অবস্থান করে এবং দেশে ফিরে এসে ১০-১২ জনের একটি মানবপাচার চক্র গড়ে তোলে এবং অবৈধভাবে বিদেশে লোক পাঠাতো। সে প্রায় ১০-১২ বছর যাবৎ মানব পাচারের এই চক্রটি পরিচালনা করছে বলে জানা যায়। গ্রেফতারকৃত ইসমাইল নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করে এই চক্রের দেশে এবং বিদেশে অবস্থিত অন্যান্য সদস্যদের সাথে সমন্বয় করে অবৈধভাবে মানব পাচার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে এবং ইতিপূর্বে সে কারাভোগ করেছে বলে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃত জসিম ও এলাহী চক্রটির অন্যতম সহযোগী। তারা নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করে বিভিন্ন এলাকা থেকে বিদেশ গমনে প্রত্যাশীদের সংগ্রহ করে গ্রেফতারকৃত ইসমাইলের নিকট নিয়ে আসতো। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃত আসামির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।