১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। রাজশাহী পুলিশ লাইনে আক্রমণ করে বসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সহযোগিতা না পাওয়ার অজুহাতে হানাদাররা চেয়েছিল পুলিশ লাইন দখলে নিতে। কিন্তু পুলিশ বাহিনীর অকুতোভয় সদস্যরা বুক চিতিয়ে দাঁড়ান। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে রুখে দেন হানাদার বাহিনীদের আক্রমণ। তিন দিন প্রাণপণে লড়াই চালিয়ে যান পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।
রাজশাহীর প্রথম সম্মুখ প্রতিরোধ যুদ্ধ এটি। এই যুদ্ধে শহীদ হন পুলিশ বাহিনীর ১৭ বীর সৈনিক। পুলিশ লাইনের গণকবরে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন তারা।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনারা রাজশাহী পুলিশ লাইন দখলে নিতে পুলিশের ওপর অতর্কিত গুলিবর্ষণ করে। এ সময় পুলিশ সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালান। বাঙালি পুলিশের নেতৃত্বে থাকেন হাবিলদার আতিয়ার রহমান।
হাবিলদার রমজান আলী পুলিশ লাইন অস্ত্রাগারের দায়িত্বে ছিলেন। ২৬ মার্চ সকালে হাবিলদার আতিয়ার অস্ত্রাগারের অস্ত্র ও গোলাবারুদ পুলিশ সদস্যদের হাতে তুলে দিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধের আহ্বান জানান। তিনি পুলিশ লাইনে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন।
পুলিশ লাইনে প্রতিরোধের প্রস্তুতির সংবাদ পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে পোঁছানোর পর তারা রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি মামুন মাহমুদকে পুলিশ সদস্যদের আত্মসমর্পণ এবং অস্ত্রাগারের চাবি হস্তান্তরের আদেশ দেন। তিনি আদেশ পালনে অসম্মতি জানান।
২৬ মার্চ সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সেনারা আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুলিশ লাইনের কাছাকাছি এসে কয়েকটি গুলি ছোড়ে। জবাবে পুলিশ লাইন থেকেও গুলি ছোড়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা উপশহরের সেনানিবাসে ফিরে যায়। উভয় পক্ষের গোলাগুলিতে কয়েকজন নিরীহ লোক প্রাণ হারান।
২৬ মার্চ রাত প্রায় ১২টা ৫ মিনিটে পাকিস্তানি বাহিনী পূর্বদিকের ফাঁকা জায়গা দিয়ে পুলিশ লাইনের দিকে এগোতে থাকে। তারা পুলিশ সদস্যদের প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
২৭ মার্চ সকাল থেকে আবারও পাকিস্তানি বাহিনীর তৎপরতা বাড়তে থাকে। পুলিশ লাইনকে ঘিরে তারা আধুনিক ও ভারী অস্ত্র স্থাপন করে। যুদ্ধ প্রস্তুতির পাশাপাশি তারা কূটকৌশলেরও আশ্রয় নেয়। সকাল ১০টায় পাকিস্তানি বাহিনীর এক কর্মকর্তা মাইকের মাধ্যমে ভাইয়ে ভাইয়ে আত্মঘাতী যুদ্ধ বন্ধের অনুরোধ জানান। পাশাপাশি আলোচনার মাধ্যমে শান্তি স্থাপন করতে বলেন।
রাজশাহী জেলার পুলিশ সুপার শাহ আবদুল মজিদ পিএসপি পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা বিষয়ে পুলিশ সদস্যদের মতামত জানতে চাইলে তারা আলোচনার বিপক্ষে মত দেন। পরে সমঝোতা হয়, উভয় পক্ষের কেউ কাউকে আক্রমণ করবে না।
কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। বেলা আনুমানিক ৩টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে সেনানিবাস থেকে পুলিশ লাইনের উদ্দেশে রওনা হয়। খবরটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ সদস্যরা আক্রমণ প্রতিহত করতে প্রস্তুত হন।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনারা উত্তর ও পূর্বদিক থেকে পুলিশ লাইন ঘিরে অবস্থান নিয়ে পুলিশ বাহিনীকে আত্মসমর্পণে চাপ দিতে থাকে।
২৭ মার্চ বিকেলে পাকিস্তানি সেনারা পূর্বদিক থেকে গুলি ছুড়তে শুরু করে। হাবিলদার আতিয়ার রহমানের নেতৃত্বে পুলিশ সদস্যরাও তখন রাইফেলের মাধ্যমে পাল্টা জবাব দেয়। সারারাত গোলাগুলি চলে।
২৮ মার্চ সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর এক মেজর রাজশাহী জেলা প্রশাসকের সাহায্য নিয়ে গোলাগুলি বন্ধ করতে পুলিশ বাহিনীকে মাইকে আহ্বান করেন। দুই পক্ষ থেকে গুলি করা বন্ধ হলে মেজর তার পাঁচ-ছয়জন সঙ্গী নিয়ে নিরস্ত্র অবস্থায় পূর্বদিক থেকে পুলিশ লাইনে যান।
ভবিষ্যতে উভয় পক্ষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করবে- এই আশ্বাস দিয়ে তিনি নিজের বাহিনী নিয়ে সেনানিবাসের দিকে চলে যান। পুলিশ সদস্যরা মেজরের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে প্রতিরক্ষা সরিয়ে ব্যারাকে ফিরে আসেন। বাঙ্কারে থেকে যান কয়েকজন পুলিশ সদস্য।
বেলা ২টার দিকে পুলিশ সদস্যরা খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কেউ কেউ খেতে বসেছেন। এমন সময় পাকিস্তানি বাহিনী মর্টার ও ভারী মেশিনগান নিয়ে তাদের ওপর অতর্কিতে হামলা করে।
বোয়ালিয়া ক্লাবের ছাদ থেকে নিক্ষেপ করা মর্টারের প্রথম শেলটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বর্তমান পুলিশ স্কুলের প্রায় ১শ গজ পশ্চিমে গোলাম মোস্তফার বাড়িতে আঘাত করে। এতে গোলাম মোস্তফা, তার ছেলে, ভাগ্নেসহ পাঁচজন শহীদ হন।
পরের শেলটি আঘাত করে পুলিশ লাইনের ওয়্যারলেস টাওয়ারে। কয়েকটি ব্যারাকে আগুন লেগে যায়। পুলিশ সদস্যরা শুরু থেকেই পুলিশ লাইনের উত্তর ও পূর্বদিককে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন বলে পাকিস্তানি বাহিনী সেদিক দিয়ে এগোতে পারেনি। কিন্তু দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বদিক ছিল প্রায় অরক্ষিত।
এই দুর্বলতা টের পেয়ে এক দল সেনা এদিক দিয়ে অতর্কিতে পুলিশ লাইনে ঢুকে আক্রমণ চালায়। ঘটনার আকস্মিকতায় পুলিশ সদস্যরা দৌড়াদৌড়ি করতে থাকেন। যারা বাঙ্কারে ছিলেন, তারা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। সন্ধ্যার আগেই পুলিশ লাইনের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানিদের হাতে চলে যায়। শেষ হয় রাজশাহীর প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ।
২৮ মার্চের ভয়াবহ যুদ্ধে শহীদ হন আর্মড এসআই এনায়েত খান, কনস্টেবল অধ্যাপক আবদুুল আজিজ, ওসমান খান, আবদুুর রহমান, আক্কাস আলী, রইছ উদ্দিন, জয়নাল আবেদীন, আলাউদ্দিন, আলীমুদ্দিন, আবদুুল হামিদ, সাদেকুল ইসলাম, মেছের উদ্দিন, আবু ইলিয়াস, আবদুুর রাজ্জাক, আবদুুল মালেক, সিরাজুল ইসলাম, আবদুুল আজিজ মোল্লা। এই বীর শহীদ পুলিশ সদস্যদের গণকবর দেওয়া হয় পুলিশ লাইনের পূর্বদিকে।
স্বাধীনতা দিবসে জাতির বীর সন্তানদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছে রাজশাহী পুলিশ। পুলিশ লাইন গণকবরে বীর শহীদদের শ্রদ্ধা জানান রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক। এ সময় নগর পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।