বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) নিষেধাজ্ঞা দিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্র দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য ইভান স্টেফানেক ইইউ’র পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল বরাবর চিঠিটি দিয়েছেন।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, র্যাবকে নিষেধাজ্ঞা দিতে ইইউ’র পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধানকে বৃহস্পতিবার (২০ জানুয়ারি) চিঠিটি দেন স্টেফানেক।
চিঠিতে স্টেফানেক লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য আমি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের অমানবিক আচরণ প্রকাশিত হয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।’
‘এই পরিস্থিতি বর্তমানে খুবই মারাত্মক। কারণ মার্কিন সরকার বর্তমান পুলিশের আইজিপি যিনি আগে র্যাবের প্রধান ছিলেন তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিশেষত টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুল হককে ২০১৮ সালের মে মাসে হত্যা করার জন্য এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।’
‘ম্যাগনিটাইনেজ গ্লোবাল প্রোগ্রামের আওতায় বাংলাদেশের আরও পাঁচজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সিনেট সদস্য বছরের পর বছর ধরে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলে আসছিল।’
‘দ্যা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস বলছে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে, পুলিশ এবং র্যাবের দ্বারা ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। ২০১৮ থেকে ২১ সাল পর্যন্ত এক হাজার ১৩৪টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে আমি আপনাকে র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য আপনার ক্ষমতা ব্যবহারের অনুরোধ করছি।’
গত ১০ ডিসেম্বরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে পৃথকভাবে এ নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দপ্তর।
এরপর গত ২০ জানুয়ারি র্যাবকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন থেকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে ১২টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা।
চিঠিতে কাতার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরায় প্রকাশিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার মেন’ প্রসঙ্গ টেনে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য লিখেছেন, আল জাজিরা কর্তৃক প্রকাশিত ‘সবাই প্রধানমন্ত্রী লোক’ ডকুমেন্টারিতে দেখানো হয়েছে, ক্ষমতাসীন দল, পুলিশ, মিলিটারি এবং সন্ত্রাসীদের মধ্যে একটা গোপন চুক্তি হয়েছে। এই গোপন চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হলো দুর্নীতি করা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করা।
এটা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশ একটা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। যেখানে মাফিয়াদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে সরকার দুর্নীতি করছে এবং পুলিশ সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশের জনগণ মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী, অবৈধ এবং অগণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে বসবাস করছে।
বোরেলকে লেখা চিঠিতে স্টেফানেক আরও লিখেছেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশে গুম হওয়া নাগরিকদের সংখ্যা আরেকটি ভীতিকর পরিসংখ্যান। এই সংখ্যা শত শত, পাঁচ’শর বেশি। এক শ্রেণীর মানুষ কর্তৃক এই সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। আরও দুঃখজনক যে গুম হওয়া মানুষদের মাঝখান থেকে অনেককেই মৃত অবস্থায় ফেরত পাওয়া গেছে। জাতিসংঘ এ বিষয়ে একটি তদন্তও করেছে।
চিঠিতে স্টেফানেক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রসঙ্গ টেনে লিখেছেন, পূর্বে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা, জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ এবং ইইউ বাংলাদেশ সরকারের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সমালোচনা করে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে মুক্ত চিন্তা, অনলাইনে ভিন্নমত দমন এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করা হচ্ছে।
বর্তমান সরকারের সমালোচনা করে স্টেফানেক লিখেছেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে চেপে ধরা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ- সংবাদপত্রের জন্য ভীতিকর পরিস্থিতি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অপমান এবং অত্যাচার। আদালতগুলো সরকার দ্বারা প্রভাবিত। আদালতে নির্বাহী কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত এবং বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তের মধ্যে খুবই সামান্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সাধারণ নাগরিক এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দ্বিমত করার সুযোগ নেই।
দ্যা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের মতে, গত বছর দক্ষিণ এশিয়ায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্ন। মুক্তচিন্তা এবং সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনাকারীকে প্রত্যহ নির্যাতন, গুম এবং অত্যাচারের শিকার হতে হয়। বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুবই মারাত্মক। আমি আপনাকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
বোরেলকে লেখা চিঠিতে স্টেফানেক আরও লিখেছেন, ২০২৬ সালে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভলপমেন্ট পলিসির সুপারিশে বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ একটা দূরদর্শী বিষয়। পরপর দুইবার ২০১৮ এবং ২০২১ সালে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে মান উত্তরণের জন্য এই স্ট্যাটাস বাংলাদেশ পাবে। বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশের চেয়ে অনেকগুলো সূচকে এগিয়ে আছে। বিশেষত দুই দশক ধরে ছয় শতাংশের ওপরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। আসন্ন অনেক অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প শেষ হলে বাংলাদেশের আরও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নের একটা বড় বাধা হলো মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতি।
উল্লেখ্য, সদ্য শেষ হওয়া বছরের শেষ মাসের শুরুর প্রান্তিকে খালেদা জিয়ার প্রয়োজনীয় চিকিৎসার বিষয়ে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বনে বিদেশ যেতে অনুমতি দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছিলেন এই স্টেফানেক।