ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী চলতি বছর ব্যাপক বিতর্কিত জম্মু ও কাশ্মির অঞ্চলে ১৫ বিদেশিসহ অন্তত ৬২ বিচ্ছিন্নতাবাদীকে হত্যা করেছে। রোববার সেখানকার জ্যেষ্ঠ একজন পুলিশ কর্মকর্তা এই তথ্য জানিয়েছেন।
ভারত এবং পাকিস্তান পৃথক দুই কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ করলেও উভয় অংশকে নিজেদের বলে দাবি করে দেশ দু’টি। ভারত-অধিকৃত কাশ্মিরের বাসিন্দারা কয়েক যুগ ধরে নয়াদিল্লির শাসনের বিরোধিতা করে স্বাধীনতার দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন করে আসছেন।
পারমাণবিক অস্ত্রধারী দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশি এ দুই দেশ ইতোমধ্যে তিনবার যুদ্ধে জড়িয়েছে। এর মধ্যে কাশ্মির সঙ্কট ঘিরে তাদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছে দু’বার। ভারত বলছে, ইসলামপন্থি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে তাদের ঘাঁটি সম্প্রসারণ থেকে বিরত রাখতে চায় নয়াদিল্লি। একই সঙ্গে ভারত-শাসিত কাশ্মিরের স্বাধীনতা চায় এমন বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীকে পাকিস্তান অর্থায়ন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে ভারতের। তবে ইসলামাবাদ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
রাজ্যের পুলিশ প্রধান বিজয় কুমার বলেছেন, চলতি বছর নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে নিহত কয়েকজনের সঙ্গে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী লস্কর-ই-তাইয়েবার সম্পর্ক রয়েছে। কাশ্মিরে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নিতে গত কয়েক বছরে অনেক মানুষকে নিজেদের দলে নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে লস্কর-ই-তাইয়েবার বিরুদ্ধে।
লস্কর-ই-তাইয়েবার জিহাদি লড়াইয়ের অন্যতম এক বৈশিষ্ট্য হল গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করা; যেখানে পুরুষরা মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন। তবে তারা আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী নন।
কুমার বলেছেন, ভারতীয় কাশ্মিরে ২০১৯ সালে প্রাণঘাতী হামলা চালানোর দায় স্বীকার করা পাকিস্তান-ভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী জয়েশ-ই-মোহাম্মদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযানে নিহত অন্তত ১৫ বিচ্ছিন্নতাবাদীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
তিনি বলেন, জনবল বৃদ্ধি, প্রযুক্তিগত তথ্য সহায়তা এবং একেবারে নিখুঁত অভিযানের কারণে জঙ্গিদের বেঁচে যাওয়ার হার ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ভারতবিরোধী কাশ্মিরি বিচ্ছিন্নতাবাদী অন্যতম বৃহত্তম সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিনের সদস্যরাও নিহতদের মধ্যে রয়েছেন।
কাশ্মিরের পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেছেন, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযানে ২০২১ সালে ১৯৩ জন এবং ২০২০ সালে ২৩২ জন বিচ্ছিন্নতাবাদী নিহত হয়েছেন। এই অঞ্চলে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান এবং নির্বিচারে ধরপাকড় একেবারে সাধারণ ঘটনা। ১৯৮৯ সাল থেকে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন চালিয়ে আসছেন সেখানকার বাসিন্দারা।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বলছে, কাশ্মিরে ভারতীয় সেনাদের নির্বিচারে আটক ও হত্যা ব্যাপক পরিসরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের দিকে যাচ্ছে। উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর ১৯৪৭ সাল থেকে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই প্রতিবেশির বিবাদের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে হিমালয় অঞ্চলের কাশ্মির। বিবাদপূর্ণ কাশ্মিরের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু উভয় দেশই দুই কাশ্মিরকে নিজেদের বলে দাবি করে। কাশ্মির নামে ছোট একটি অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চীনেরও।
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাওয়ার পর এ দুই প্রতিবেশি দেশ ১৯৪৮, ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালে তিনবার পুর্ণমাত্রার যুদ্ধে জড়িয়েছে। এরমধ্যে কেবল কাশ্মির ঘিরেই দুই দেশের মাঝে যুদ্ধ হয়েছে দু’বার। ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো স্বাধীনতা অথবা প্রতিবেশি পাকিস্তানের সঙ্গে মিলিত হওয়ার দাবিতে সেখানে দশকের পর দশক ধরে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থার মতে, ১৯৮৯ সালে নয়াদিল্লির শাসনের বিরোধিতায় শুরু হওয়া সশস্ত্র বিদ্রোহে এখন পর্যন্ত এই অঞ্চলে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।
তবে হিমালয়ের কোল ঘেঁষে থাকা এই অঞ্চলটিতে নতুন করে উত্তেজনা শুরু হয় ২০১৯ সালে। ওই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন সরকার কাশ্মিরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসন সংক্রান্ত ভারতীয় সংবিধানের বিশেষ অনুচ্ছেদ বাতিল করে দেওয়ার পর নতুন করে সংঘাত শুরু হয়। মোদি সরকারের এই পদক্ষেপ পাকিস্তানকেও ক্ষুব্ধ করে তোলে।
সূত্র: রয়টার্স, আলজাজিরা।