রাজধানীর মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, ঢাকার আমিনবাজার, তুরাগ, কেরানীগঞ্জ ও সাভার এলাকায় জমি দখল, হাউজিংয়ে, নৌপথে, মার্কেট ও বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি যেন মোশারফ বাহিনীর নেশা। বাধা পেলে হামলা, খুন ও অপহরণ করত তারা। আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি তারা জড়িত মাদক কারবারেও। শুধু তাই নয়, বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীতে বালু ভর্তি ট্রলার, ইটের কার্গো ও অন্য জাহাজ আটকিয়ে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি করত। আদায় করত মাসিক চাঁদাও।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা করত তারা। র্যাব-পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা ও হত্যা মামলা রয়েছে মোশারফ বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ‘মোশারফ’ বাহিনীর মূলহোতা ও শীর্ষ সন্ত্রাসী মোশারফ হোসেন ওরফে লম্বু মোশারফ ওরফে গলাকাটা মোশারফ ওরফে গাংচিল মোশারফসহ তার পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তারের পর এমন তথ্য জানিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। সোমবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, ২০১৭ সালে গাংচিল গ্রুপের প্রধান আনারের মৃত্যুর পর গাংচিল গ্রুপ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয় এবং তৎকালীন ওই গ্যাংয়ের সেকেন্ড ইন কমান্ড শীর্ষ সন্ত্রাসী লম্বু মোশারফের নেতৃত্বে মূল একটি অংশ পরিচালিত হচ্ছিল।
গোয়েন্দা কার্যক্রমের ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়ার পর র্যাব-২ এর একটি দল রোববার (২৭ ফেব্রুয়ারি) রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে গলাকাটা মোশারফ ওরফে গাংচিল মোশারফ (৪৫), সহযোগী বিল্লাল ওরফে বিল্লাল হোসেন ওরফে চোরা বিল্লাল (৩০), মোহন ওরফে বাইক মোহন (৩১), সাহাবুদ্দিন সাবু ওরফে জলদস্যু সাবু (৪৪), রুবেল ওরফে ট্রলার রুবেল (৩৩) ও সুমন মিয়া (৩০) কে গ্রেপ্তার করে। অভিযানে জব্দ করা হয় একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, ৪ রাউন্ড গুলি, তিনটি বড় ছোরা, দুটি চাপাতি, দুটি চাকু, একটি চাইনিজ কুড়াল, একটি দা, একটি ফ্রেমসহ হেসকো ব্লেড, গ্রিল কাটার, ৪২৩ পিস ইয়াবা।
জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তাদের দলের সদস্য সংখ্যা ২৫-৩০ জন। লম্বু মোশারফের নেতৃত্বে বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করতো। লম্বু মোশারফের নির্দেশে তার সহযোগীরা বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীতে বালু ভর্তি ট্রলার, ইটের কার্গো ও অন্য জাহাজ আটকিয়ে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি করত।
ইটভাটার মালিকের কাছ থেকে মাসিক চাঁদা আদায় করত তারা। বিভিন্ন হাউজিং এলাকায় নির্মাণাধীন ভবন, নতুন বাড়ির মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছে জমি দখলের নামে চাঁদাবাজি করত। কেউ চাঁদা দিতে রাজি না হলে তারা বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি দেখাত, চাঁদা না পেলে রাতের আঁধারে নিরাপত্তা কর্মীকে মারধর, নির্মাণ কাজের উপকরণ জোরপূর্বক নিয়ে যেত। সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তারা দেশি ও বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রসহ অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র দ্বারা সাধারণ মানুষকে ভয় দেখাত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের এ অপরাধ কর্মকাণ্ডে বাধা দিলে তারা বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা করে।
এছাড়া আধিপত্য বজায় রাখাসহ অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে লম্বু মোশারফ গ্রুপের সদস্যরা একাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করত। তারা অধিকাংশ সময় নদীর কাছে আস্তানা গড়ে তুলে এবং নদী পথে ডাবল ইঞ্জিন চালিত ট্রলার ব্যবহার করে যাতায়াত করত।
বেবি টেক্সির চালক থেকে গাংচিল বাহিনীর প্রধান লম্বু মোশাররফ
লম্বু মোশারফ ভোলার বোরহানউদ্দীনের একটি বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। ১৯৯০ সালে ঢাকায় আসেন। প্রথমে বেবি ট্যাক্সি ও সিএনজি চালাতেন। পরে হাউজিং প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। ২০০০ সালে রাজধানীর কাফরুল থানা এলাকায় ছিনতাইয়ের মাধ্যমে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে। পরে গাংচিল বাহিনীর প্রধান আনারের মাধ্যমে গাংচিল বাহিনীতে যোগ দেয়। ২০১৭ সালে আনারের মৃত্যুর পর গাংচিল বাহিনী বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে মূল অংশের নেতৃত্ব নিয়ে সেকেন্ড ইন কমান্ড হয় লম্বু মোশারফ। মারামারিসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সময় ভুক্তভোগীকে গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার কারণে ‘গলাকাটা মোশারফ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যাচেষ্টা, ছিনতাই, ডাকাতি, অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ, অপহরণ, পুলিশের ওপর হামলাসহ ১৫টির বেশি মামলা রয়েছে। বিভিন্ন মেয়াদে একাধিকবার কারাভোগও করেছেন তিনি।
গ্রেপ্তার চোরা বিল্লাল ২০০৬ সালে মুন্সিগঞ্জ থেকে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় আসে। প্রথমে গার্মেন্টসে পরে গাড়ির হেলপারের কাজ করে। ২০১৭ সালে লম্বু মোশারফের সঙ্গে পরিচয় হয়, পরে অন্যতম সহযোগী হিসেবে পরিচিত পায়। সিঁধকাটা, গৃহস্থলীর তালা ভাঙাসহ অন্য চৌর্যবৃত্তিতে পারদর্শীতার কারণে ‘চোরা বিল্লাল’ হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ১০টি মামলা রয়েছে।
গ্রেপ্তার বাইক মোহন লম্বু মোশারফের অন্যতম সহযোগী। তিনি ২০১০ সালে ভোলা থেকে ঢাকায় এসে ঢাকা উদ্যান এলাকায় বসবাস শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে গার্মেন্টসে চাকরি, রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে মোটরবাইক চালানোর কাজ করতেন। পরে ২০১৮ সালে একটি রিয়েল এস্টেটে চাকরির সময় লম্বু মোশারফের দলে যোগ দেন। ছিনতাই, ধর্ষণ, হত্যাচেষ্টাসহ ৮টির বেশি মামলায় একাধিকবার কারাভোগ করেছেন তিনি।
গ্রেপ্তার জলদস্যু সাবু মোহাম্মদপুর এলাকায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করতেন। ২০১৭ সালে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির সময় মোশারফ বাহিনীতে যোগ দেন। লম্বু মোশারফের নির্দেশে তিনি বুড়িগঙ্গা নদীতে বিভিন্ন মালবাহী নৌকা ও ট্রলারে চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও অপহরণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে সাভার ও মোহাম্মদপুর থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য, চাঁদাবাজি, হত্যাচেষ্টা, মাদক, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে ছয়টি মামলা রয়েছে।
ট্রলার রুবেল ২০০৬ সাল থেকে মোহাম্মদপুরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ট্রলার চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ২০১৮ সালে মোশারফ বাহিনীতে যোগ দেন। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর বিভিন্ন মালবাহী নৌকা ও ট্রলারে চাঁদাবাজি/ডাকাতির সময় তিনি নৌকা বা ট্রলার চালাতেন বলে ট্রলার রুবেল হিসেবে পরিচিত পান। তার বিরুদ্ধে ছিনতাই, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে সাভার ও মোহাম্মদপুর থানায় তিনটি মামলা রয়েছে।
সুমন মিয়া ঢাকার বাবুবাজার এলাকায় গার্মেন্টসে চাকরি ও ডিসের লাইনে কাজ করেছেন। ২০২০ সালে মোশারফের দলে যোগ দেন। মাদক সংগ্রহ ও মাদক পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতেন সুমন। তার বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় মাদক ও চাঁদাবাজি সংক্রান্ত দুটি মামলা রয়েছে।