ভয়াবহ রানা প্লাজা দুর্ঘটনার ৯ বছরেও মিলল না বিচার। দেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম ধ্বংসযজ্ঞ সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ১ হাজার ১৩৮ জন পোশাক শ্রমিক মারা যায়। আলোচিত এ ঘটনার পর কেটে গেল নয় বছর। আর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দায়ের করা হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের পৃথক দুই মামলার শেষ হয়নি বিচারকাজ আজও।
এদিকে রানা প্লাজার ৯ বছর উপলক্ষে গার্মেন্টস শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিলসসহ বিভিন্ন শ্রমিক ও সামাজিক সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করবে আজ। এর মধ্যে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে সকালে রাজধানীর জুরাইন কবরস্থানে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হবে। বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসানসহ সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা এ সময় উপস্থিত থাকবেন। এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে জুরাইন কবরস্থান এবং সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছে ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনে অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হবে।
আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই হত্যা মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত। ওই আদেশের বিরুদ্ধে বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সাত আসামি হাইকোর্ট বিভাগে আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলার কার্যক্রম কয়েক বছর স্থগিত ছিল। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের ভারপ্রাপ্ত পিপি বিমল সমাদ্দার বলেন, অভিযোগ গঠনের পর কয়েকজন আসামি উচ্চ আদালতে গিয়ে মামলাটি স্থগিত করেন। এ কারণে মামলার বিচার প্রক্রিয়া অনেক বছর স্থগিত ছিল। বর্তমানে উচ্চ আদালতে এ মামলায় আর কোনো স্থগিতাদেশ নেই। যার ফলে আমরা ইতোমধ্যে বাদীর সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছি। আগামী ৯ এপ্রিল এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, নিয়মিত ধার্য তারিখে সাক্ষীরা যদি আদালতে সাক্ষ্যপ্রদানের জন্য আসেন, তাহলে দ্রুত এ মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে। হত্যা মামলাটি বর্তমানে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন।
অপরদিকে ২০১৬ সালের ১৬ জুন ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। ওই আদেশের বিরুদ্ধে বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বজলুস সামাদ আদনানসহ চার আসামি রিভিশন মামলা করেন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পিপি আনোয়ারুল কবির বাবুল বলেন, আবেদনকারীদের মধ্যে নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বজলুস সামাদ ও সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের রিভিশন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন আদালত।
অপরদিকে ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামসহ অপর একজনের রিভিশন মঞ্জুর করে তাদের এ মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ ছাড়া এ মামলার অপর আসামি সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র রেফাত উল্লাহ হাইকোর্ট বিভাগে মামলা স্থগিতের আবেদন করেন। শুনানি শেষে হাইকোর্ট আগামী ৭ নভেম্বর পর্যন্ত এ মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত করেছেন। ফলে এ মামলায় এখনও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যায়নি।
আসামি সোহেল রানার আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের দুই মামলায় প্রায় ছয় বছর আগে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এই আদেশের বিরুদ্ধে কয়েকজন আসামি উচ্চ আদালতে যান। এদের মধ্যে সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র রেফাত উল্লাহর পক্ষে মামলার কার্যক্রম স্থগিতাদেশ থাকায় ইমরাত নির্মাণ আইনের মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হচ্ছে না। তবে ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় রানা হাইকোর্ট থেকে জামিনে রয়েছেন। তিনি আরও বলেন, হত্যা মামলায় রানা ছাড়া সবাই জামিনে আছেন। হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত একজনের সাক্ষী হয়েছে কিন্তু আদালত রানাকে জামিন দিচ্ছে না। রাষ্ট্রপক্ষের উচিত ইমারত নির্মাণ আইনের মামলা দ্রুত স্থগিতাদেশ নিষ্পত্তি করে মামলার কার্যক্রম চালু করা।
২০১৫ সালের ১ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের পৃথক দুই মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, প্রাথমিক তদন্তে বাদীর দায়েরকৃত অভিযোগের আলোকে প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় অভিযোগপত্র দাখিল করা হলো। দুই মামলায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে খালেক কুলুসহ ৫৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে আসামিদের মধ্যে ১৭ জনের নাম উভয় মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ থাকায় ব্যক্তি হিসেবে আসামি ৪২ জন। এর মধ্যে হত্যা মামলায় ৪১ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং সাক্ষী করা হয়েছে ৫৯৪ জনকে। এ ছাড়া ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ১৮ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং সাক্ষী করা হয়েছে ১৩৫ জনকে। এই দুটি মামলার মধ্যে হত্যা মামলায় ৪১ জন আসামির মধ্যে দুইজন আসামি মারা যাওয়ায় এখন আসামির সংখ্যা ৩৯ জন। অপরদিকে ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ১৮ জন। বর্তমানে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ছাড়া অন্য আসামির সবাই এখন জামিনে মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
ভালো নেই আহত শ্রমিকরা : রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক নিহত হওয়ার পাশাপাশি আহত হয় প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক। এদের মধ্যে কেউ দুই পা হারিয়েছেন, কেউ হারিয়েছেন দুই হাত, আবার কারও মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়ায় হয়ে গেছেন চিরতরে পঙ্গু। দুর্ঘটনার এই ৯ বছর পরও এই আহত ও পঙ্গু শ্রমিকরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। নানা রকম সঙ্কটের কারণে এখন ভালো নেই এসব আহত শ্রমিক।
এদের একজন নিলুফা বেগম। থাকেন সাভারের রাজাশন এলাকার পলোয়ানপাড়ায়। স্বামী আর এক সন্তান নিয়ে তার সংসার। তার স্বপ্ন ছিল একমাত্র সন্তান রিফাত পাটওয়ারীকে ভালো স্কুলে লেখাপড়া করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবে; কিন্তু রানা প্লাজার ধসে তার সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। এখন ছেলের লেখাপড়া তো দূরের কথা, দুই বেলা দুমুঠো ভাত ঠিকমতো খেতেও পায় না তারা। নিলুফা বেগম বলেন, তিনি রানা প্লাজার পঞ্চম তলায় ফ্যান্টম অ্যাপারেলসে কাজ করতেন। ভবন ধসে পড়ার সাড়ে ৯ ঘণ্টা পর উদ্ধারকারীরা তাকে উদ্ধার করে। পিলারের নিচে চাপা পড়ে তার ডান পা অকেজো হয়ে গেছে। বিভিন্ন হাসপাতালে ৯ মাসের বেশি চিকিৎসা করিয়েছেন তিনি। চিকিৎসকরা তার ডান পা কেটে ফেলতে চাইলে তিনি সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তা কাটতে দেননি। দুর্ঘটনার পর যা কিছু সাহায্য- সহযোগিতা পেয়েছিলেন সেগুলো শেষ হয়ে গেছে। এখন অনেক কষ্টে জীবন চলছে।
আরেক আহত শ্রমিক আশরাফুল ইসলাম সুজন। কাজ করতেন রানা প্লাজার ষষ্ঠতলায় ইথার টেক্স কারখানায়। ভবন ধসে পড়ার দিন সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টার দিকে উদ্ধারকারীরা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করান। শেষে সাভার সিআরপিতে চিকিৎসা করিয়েছেন তিনি। আশরাফুল ইসলাম সুজন ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, সরকারিভাবে ও বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে সাড়ে ৭ লাখ টাকা পেয়েছি। প্রথমে ফ্রি চিকিৎসা পেলেও হাসপাতাল থেকে রিলিজ করার পর আবার হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গেলে টাকা দাবি করে। তবে টাকার অভাবে তিনি চিকিৎসা করাতে পারছেন না বলে জানান। তিনি বলেন, এখন আর আমাদের কেউ খোঁজ নেয় না। বিজিএমইএর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল তারা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে; কিন্তু এখন আর তাদের কোনো হদিস নেই।
কী বলছেন বিজিএমইএ নেতারা : এ বিষয়ে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম সময়ের আলোকে বলেন, ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর থেকে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে নিহত শ্রমিক পরিবার এবং আহত শ্রমিকদের পাশে সর্বোচ্চ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এখনও যদি আহত কোনো শ্রমিক আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, চিকিৎসা বা অন্য কোনো বিষয়ে আমরা তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। বিজিএমইএ সব সময় পাশে আছে রানা প্লাজার আহত শ্রমিকদের।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে নয় তলাবিশিষ্ট রানা প্লাজাটি ধসে পড়লে ১ হাজার ১৩৬ জন পোশাক শ্রমিক মারা যায়। জীবিত উদ্ধার করা হয় প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিককে। ঘটনার পরদিন সাভার থানা পুলিশের এসআই ওয়ালী আশরাফ খান অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ ২১ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। এ ছাড়া রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অথরাইজড অফিসার হেলাল উদ্দিন ইমারত নির্মাণ আইনে ১৩ জনকে আসামি করে আরও একটি মামলা করেন।