১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে। সেই ভাষা আন্দোলনে পিছিয়ে ছিল না রংপুর। ভাষার জন্য উত্তাল সেই সময়ে রংপুরেও মিছিল-মিটিং সমাবেশ হয়েছে। ছাত্রসমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্রীয় ভাষার দাবিতে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। বাংলা ভাষার জন্য গড়ে ওঠা সেই আন্দোলনের সংগ্রামী যোদ্ধাদের একজন মোহাম্মদ আফজাল। স্কুল জীবন থেকে সংগ্রাম করে আসা এই ভাষাসৈনিক এখনো বৈষম্য, বঞ্চনা বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। কেমন ছিল ১৯৫২’র তখনকার প্রেক্ষাপট, গেল সাত দশকেই বা কতটুকু অর্জন হয়েছে আমাদের- এসব নিয়ে কথা বলেছেন ভাষাসৈনিক ও প্রবীণ রাজনীতিক মোহাম্মদ আফজাল। জীবনের পড়ন্ত বেলায় তার চাওয়া নতুন প্রজন্মের হাত ধরে বাংলা ভাষার সর্বত্র ব্যবহার নিশ্চিত হোক। সাম্প্রদায়িকতা রুখে সাম্যের ভিত্তিতে বৈষম্যহীন সমতার সমাজ গড়ে উঠুক।
রংপুর জিলা স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন মোহাম্মদ আফজাল। বয়সে ছোট হলেও প্রতিটি মিটিং মিছিলে তার ছিল উচ্চকণ্ঠ। বড়দের ভিড়ে সাহসের তকমা ছড়িয়েছেন। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে তার রাজনীতির শুরু। দীর্ঘদিন ছিলেন গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতি। এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদেরও একজন তিনি। দুইবার রংপুর পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যানও ছিলেন। রংপুর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি তিনি নির্মাণ করেছেন।
সংগ্রামী, নির্লোভ এই কিংবদন্তি রাজনীতির কারণে সংসার করেননি। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে গিয়ে জীবনের দীর্ঘ সময় কারাগারে ছিলেন। বর্তমানে তিনি রংপুর নগরীর মুন্সিপাড়ায় নিজ বাড়িতে একা থাকেন। বার্ধক্যের কারণে শরীর ভেঙে পড়েছে। ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। চোখেও কম দেখেন। কখনো কখনো কানে ঠিকমতো শুনতেও পান না। তারপরও ৭০ বছর আগের রক্তঝরা দিনগুলোর কথা ভুলে যাননি তিনি।
মোহাম্মদ আফজাল ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে বলেন, পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষ ছিল পূর্ব বাংলার। আমাদের ৫৬ জন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ৪৪ জন। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। মুসলিম লীগের প্রধান নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ অন্য নেতারা ক্ষমতায় বসে প্রথম থেকেই পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করতে থাকেন। তারা পূর্ব বাংলাকে সবদিক দিয়ে বঞ্চিত করতে শুরু করেন। এর মধ্যে বাংলা ভাষাকে তারা টার্গেট করে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করেন।
তিনি বলেন, আমরা পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার মানুষরা বেশি ট্যাক্স দিতাম। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও আমাদের বেশি ছিল। আমাদের কাছ থেকে পাট, পাটজাতদ্রব্য, তামাক, চা নিয়ে রপ্তানি করত। কিন্তু তারা পূর্ব বাংলার উন্নয়নে কোনো কাজ করেনি। চাকরিতে তাদের সব বড় বড় সামরিক বাহিনীর অফিসার ছিল। সিপাহি পদে ১০০ জনের মধ্যে পূর্ব বাংলা থেকে ছিল মাত্র ৫ জন। পূর্ব বাংলায় কয়েকটা পাটকল ছাড়া ১০০টার বেশি কলকারখানা পশ্চিম পাকিস্তানে করা হয়। পূর্ব বাংলায় নতুন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মেডিকেল কলেজ কিছুই করেনি। আমাদের উন্নয়নে তাদের কোনো উদ্যোগ ছিল। এতে করে দিন দিন পূর্ব বাংলায় দরিদ্রতা বাড়তে থাকে। বেকার সমস্যা বাড়তে থাকে।
মোহাম্মদ আফজাল জানান, ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। এর দুটি অংশ একটা পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ পূর্ব বাংলা, আরেকটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। কিন্তু শুরু থেকেই সবদিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তান উন্নত হতে থাকে। হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আগে করাচিতে রাজধানী গড়ে তোলে। সেখান থেকে আবারো কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানী পরিবর্তন করে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে যায়। তারপর ইসলামাবাদে রাজধানী হয়েছে। বড় বড় সেচ প্রকল্প সব পশ্চিম পাকিস্তানে করা হয়। আর পূর্ব বাংলায় ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তা নদীর পানির সেচ উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের নদী ঘিরে ভারতের সঙ্গে তারা পানিবন্টনে চুক্তি করেছিল।
তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই এমন অনেক বৈষম্য ছিল। পূর্ব বাংলার মানুষ এই বৈষম্যের অবসান এবং পূর্ব বাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বার্থসংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলন করে। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী এতে নারাজ ছিল। বাঙালিরা মাথা তুলে দাঁড়াবে, এটা তারা কখনো চাননি। এ কারণেই ভাষা এবং সংস্কৃতির ওপর তারা আঘাত হানল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ শাসকগোষ্ঠীর নেতারা শুরু থেকেই বলতে থাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটা। তখন পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবীরাসহ ছাত্র, যুব ও বিভিন্ন সংগঠন থেকে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি করা হয়।
এই আন্দোলন চলমান ছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। তখন পাকিস্তান সরকার এই হরতাল কর্মসূচি ঠেকাতে ১৪৪ ধারা জারি করে। এতে পূর্ব বাংলায় ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ঢাকায় সিদ্ধান্ত হয় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা মিটিং মিছিল করবে। আমরাও রংপুরে প্রস্তুতি নিলাম।
মোহাম্মদ আফজাল বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় জমায়েত হয়। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অনেক সাধারণ মানুষও সেখানে যোগ দেয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের হয়। পুলিশি বাধা, গ্রেফতার, ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জসহ সবই করে শাসকগোষ্ঠী। এক পর্যায়ে পাল্টাপাল্টি ইটপাকটেল নিক্ষেপ করা হয়। কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার ফাঁকে হঠাৎ পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বার গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। অনেক শিক্ষার্থী সেদিন আহন হন। এই গুলিবর্ষণের খবর মুহূর্তের মধ্যে দাবানলের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালির মনে দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ঢাকার সব পাড়ামহল্লা থেকে হাজার হাজার মানুষ সড়কে নামে। মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় ঢাকার পথঘাট।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২২ ফেব্রুয়ারি শহীদদের জানাজার নামাজের পরে বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল। কিন্তু জানাজার নামাজ করতে দেয়নি শাসকগোষ্ঠী। বরং যারা শহীদ হয়েছিলেন, তাদের মরদেহ হাসপাতালের মর্গ থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। যাতে কেউ তাদের জানাজা করতে না পারে। মরদেহ ছাড়াই সেদিন গায়েবানা জানাজার নামাজ শেষে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। সেদিনও মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল।
ভাষাসৈনিক আফজাল বলেন, ২২ ফেব্রুয়ারি কারমাইকেল কলেজে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং পুনরায় এক বিরাট মিছিল নিয়ে শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এ মিছিলটিকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেছিল পুলিশ। কিন্তু বাধা উপেক্ষা করে মিছিলটি সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। তারপর প্রতিদিনই কারমাইকেল কলেজে প্রতিবাদ সভা হতো, বেরুতো মিছিলও। রংপুরে ভাষা আন্দোলনের মূল বিরোধিতাকারী ছিলেন কারমাইকেল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ শাহাব উদ্দিন। ছাত্রদের মিছিল, সভা-সমাবেশ করতে দিতেন না। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত কোথাও কোনো পোস্টার কিংবা দেয়াল লিখন দেখলেই পিয়নদের হুকুম দিয়ে ছিঁড়ে কিংবা মুছে ফেলাতেন। ছাত্র-শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করিয়েছেন।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য যে আন্দোলন হয়েছিল সেই আন্দোলনের পথ বেয়েই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। ভাষা আন্দোলন না হলে স্বাধীকার আন্দোলন, ছয় দফা, এগারো দফা, আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলনও হতো না। একমাত্র রাষ্ট্রভাষার জন্য গড়ে ওঠা আন্দোলনই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ বপন করেছিল। ভাষা আন্দোলন সফল না হলে এত দ্রুত স্বাধীনতা পেতাম না। এখন দেশ স্বাধীন। দেখতে দেখতে ৫০ বছর পার হয়ে গেল। দেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু বৈষম্যমূলক, অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিপূর্ণতা আসেনি। সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। এখনো ইংরেজিতে বিচার বিভাগে রায় লেখা হয়, বড় বড় প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি লেখা সাইনবোর্ড ব্যবহার হয়। ৭০ বছর পরও এসব দেখা আমাদের জন্য কষ্টের।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন ৮৬ বছর বয়সী মোহাম্মদ আফজাল। অনেকটা ক্ষোভ আর আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যাশা ছিল সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং সমঅধিকারের ভিত্তিতে একটা সুষম সাম্যের সমাজ হবে। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। এখনো বৈষম্য আছে, ধনী-গরিবের ব্যবধান আছে।
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানিয়েছে এই ভাষাসংগ্রামী বলেন, আমাদের সবাইকে সাম্প্রদায়িকতা রুখতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছে অমুসলিমরা। মুক্তিযুদ্ধের সময় এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, তার মধ্যে নব্বই লাখই ছিল হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ও আদিবাসীরা। অথচ এখনো তারা বিভিন্নভাবে বঞ্চিত। সাম্প্রদায়িকতা রাখা যাবে না। সব মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
প্রসঙ্গত, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রংপুরে ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ আফজালকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করে ঢাকা পোস্ট। ওইদিন আরেক ভাষা সৈনিক আশরাফ হোসেন বড়দাকেও সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়। এর আগে ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মুজিব শতবর্ষ ও বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবর রহমানকে নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্ট সম্মাননা প্রদান করে।