দেশের একমাত্র দ্বীপ জেলা ভোলায় করোনা মহামারিকেও ছাড়িয়ে গেছে বাল্যবিয়ের মহামারি। করোনা মহামারির গত দুই বছরে জেলার সাত উপজেলায় ২২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। ভুয়া জন্ম নিবন্ধন, কাজিদের অর্থ লোভী মনোভাব, উত্ত্যক্তের ফলে নিরাপত্তার অভাব, প্রশাসনের উদাসীনতা এবং সামাজিক অবক্ষয় অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে হওয়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন গবেষকরা। জেলা শিক্ষা গবেষণা কর্মকর্তা নুরে আলম সিদ্দিকী বলেছেন, জেলার সাত উপজেলার ৫৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই লাখের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। যার মধ্যে ২২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে অভিভাবকদের সচেতন এবং মেয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতি জোর দেন তিনি।
সময়ের আলোর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে বাল্যবিয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী কাজিদের অর্থ লোভ। দৌলতখান উপজেলার ২নং মেদুয়া ইউনিয়নে বিয়ের রেজিস্ট্রি করেন কাজী অ্যাডভোকেট মো. মহিউদ্দিন। বক্তব্য নিতে তার চেম্বারে গেলে তিনি এই প্রতিবেদককে ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করেন। ক্যামেরার লেন্সে হাত দিয়ে বলেন, ‘এটা রাখেন, আপনার সঙ্গে কথা বলি।’
কাজী মহিউদ্দিন তজুমদ্দিন উপজেলার ৩নং ওয়ার্ডের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছাত্রীর বিয়ে পড়ান গত ৮ মার্চ। মেয়েটির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রশংসাপত্র অনুযায়ী, ২০০৯ সালের ৫ জানুযারি তার জন্ম। অথচ কাবিননামায় বয়স দেখানো হয়েছে ২০০৪ সালের ৫ জানুয়ারি। তিন লাখ টাকায় কাবিন করা হয়। এর পরের দিন ৯ মার্চ একটি নোটারি করা হয়। যেখানে কাজি অফিস মেদুয়ার কথা উল্লেখ না করে ভোলা সদরের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া তিন লাখ টাকার স্থলে পাঁচ লাখ টাকা উল্লেখ করা হয়। নিকাহনামার রেজিস্টেশন নম্বর হচ্ছে ৩২/২০২২। বিয়েটি এলাকায় বেশ ধুমধাম করে হয়। অনুষ্ঠানে অনেক জনপ্রতিনিধিও অংশ নেন বলে খবর পাওয়া গেছে। বিষয়টি তজুমদ্দিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মরিয়ম বেগম, ইউপি চেয়ারম্যান মো. রাসেল ও ইউপি সচিব মো. মেজবাউদ্দিনসহ অনেক জনপ্রতিনিধিই জানতেন। তবে কেউ বিয়ে বন্ধে এগিয়ে আসেননি।
অ্যাডভোকেট মহিউদ্দিন দৌলতখান উপজেলার ২নং মেদুয়া ইউনিয়নের কাজী হলেও বিয়ে রেজিস্ট্রি করিয়ে থাকেন যেকোনো স্থানের। শহরের উকিলপাড়ায় তার বসার স্থান। তিনি বিভিন্ন আইনজীবীদের অনুরোধে বিয়ে পড়িয়ে থাকেন বলেও জানান। বাল্যবিয়ে পড়ানোর কথা স্বীকার করে মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমার এই ক্ষতি করা আপনার ঠিক হবে না।’ একপর্যায়ে তিনি চেম্বার ছেড়ে দ্রুত চলে যান।
ভোলার শিক্ষাব্যবস্থায় মেয়েরা বেশ এগিয়ে। তবে করোনাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় বাল্যবিয়ের হার বেড়ে গেছে। সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির মেয়েরা বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ১১ বছর থেকে শুরু করে কেউ বাদ যাচ্ছে না বাল্যবিয়ে থেকে।
তজুমদ্দিন উপজেলার চাচরা ইউনিয়নের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী লামিয়া ও আরিফা আক্তার বলেন, আমাদের ক্লাসের অনেক মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। আমরা তাদের হারিয়েছি। তবে আমরা নিজেদের হারাতে চাই না। বাল্যবিয়ে মুক্ত দেশ গড়তে চাই।
অভিযোগ রয়েছে, বাল্যবিয়ের জন্য জন্মনিবন্ধন কার্ডে বয়স বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদ সচিবরা জন্ম নিবন্ধন কার্ডে বয়স বৃদ্ধি করে প্রিন্ট বের করে দিচ্ছেন।
চাচরা ইউনিয়নের একটি ফাজিল মাদ্রাসাছাত্রী কারিমা আক্তার ও নুসরাত সুলতানা রিমা অভিযোগ করে বলেন, আমরা বাল্যবিয়ে মুক্ত দেশ গড়তে চাই। এটা সম্ভব হচ্ছে না কিছু অসৎ লোকের জন্য। টাকার বিনিময় পুলিশ প্রশাসনসহ সবাইকে ম্যানেজ করা হয়। এ ছাড়া শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়ার পথে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। মানসম্মান রক্ষায় বাবা-মা তাদের সন্তানদের বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। প্রশাসনকে অবহিত করা হলে টাকা নিয়ে চলে যায় বলেও অভিযোগ তোলে এসব শিক্ষার্থী। একই সঙ্গে মেয়েরা নেট দুনিয়ায় প্রবেশের ফলে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পরার কথাও শিকার করে তারা।
এদিকে তজুমদ্দিন উপজেলার শম্ভুপুর ইউনিয়ন পরিষদে গেলে সচিবের রুমে দেখা হয় আসমা বেগমের সঙ্গে। তার বিয়ে হয় ২০২০ সালের ১৯ মে। দুই বছর আগে হুজুর ডেকে বিয়ে হলেও হয়নি কোনো কাবিন। দুই বছর পর এক সন্তানের মা আসমা আক্তার ইউনিয়ন পরিষদে আসেন জন্ম নিবন্ধন কার্ড করতে।
বাল্যবিয়ে নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থার একজন কর্মী ফারজানা জাহান বলেন, বাল্যবিয়ে হলে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানকে অবহিত করি। কয়টা বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে পেরেছেন জানতে চাইলে চুপ থেকে তিনি বলেন, এটা আমাদের কাজ নয়। আমরা মেয়েদের সচেতন করি।
সাচড়া আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইতি বেগম বলেন, বাল্যবিয়ে সমাজ উন্নয়নে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যে বাল্যবিয়ের শিকার সে তার সন্তানদেরও বাল্যবিয়ে দেবে বলে আশঙ্কা করছি। নিজেদের ব্যর্থতার কথা শিকার করে তিনি বলেন, না জানিয়ে অভিভাবকরা বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার থাকে না। উত্তর চাচড়া মোহাম্মদিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ মো. নুরউদ্দিন, শম্ভুপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জামাল উদ্দিন, কোড়ালমারা বাংলাবাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামরুল ইসলাম এবং ভোলা সদর উপজেলার বন্ধুজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হারুন বাল্যবিয়েকে একটি মহামারির সঙ্গে তুলনা করেন।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা বলেন, প্রশাসনকে অবহিত করি। তারা আসেন, টাকা নিয়ে আবার চলে যান। ইউনিয়ন পরিষদ সচিবরা এর সঙ্গে জড়িত। আমাদের স্বাক্ষর নেওয়ার কথা থাকলেও তারা সেটা করছে না। অনিয়মটা পরিষদ ও কাজিরা মিলে করছেন। এভাবে চলতে থাকলে স্কুল মেয়েশূন্য হয়ে যাবে।
তজুমদ্দিন উপজেলার শম্ভুপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. রাসেল বলেন, যারা বাল্যবিয়ে দেবেন ওই ধরনের পরিবারকে আমরা বয়স্ক ভাতা, বিধভা ভাতা, ভিজিডি ও ভিজিএফসহ সরকারি সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার পাশাপাশি নাগরিক সনদ বন্ধের ব্যবস্থা করছি। তবে আদালতের বয়স নির্ধারণের কাগজ দেখিয়ে বাল্যবিয়ে হয় থাকলে সে ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই।
তজুমদ্দিন উপজেলার ইউএনও মরিয়ম বেগম বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে জাল সার্টিফিকেট তৈরির কথা স্বীকার করে শুধু বাবা-মা ও পরিবারের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির প্রতি জোর দেন।